শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির ঝাড়ুদার। এটি মৃত প্রাণীর দেহ ভক্ষণ করে পরিবেশ পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি নানা সংক্রমণ ও রোগবালাই থেকে রক্ষা করে। আশি-নব্বইয়ের দশকে কোনো এলাকায় গরু-মহিষ মারা গেলে শত শত শকুন এসে ভিড় করত। মুহূর্তের মধ্যে মাংস-চামড়া খেয়ে হাড়গুলো রেখে ফিরে যেত আবাসস্থলে। এখন গবাদিপশু মরে পড়ে থাকলে সেটা পরিষ্কারে দৌড়ঝাঁপ শুরু করতে হয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের বেতনভুক্ত কর্মীদের। কারণ, হারিয়ে গেছে শকুন। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ’৯০-এর দশকে এদেশের সর্বত্র শকুন দেখা গেলেও বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া শকুনের দেখা মেলে না। এ প্রজন্মের শিশুরাও প্রাণীটিকে দেখার সুযোগ পায় বইয়ের পাতায় অথবা চিড়িয়াখানায়।
শকুন রক্ষায় সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এখনো আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। শকুন এখনো কমছে। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে ৫০ হাজারের বেশি শকুন ছিল। বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর ২০২৩ সালের শুমারিতে ২৬৭টি শকুনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হবিগঞ্জ কার্যালয়ের রেঞ্জ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২১০টি শকুন বেঁচে আছে।’ গবেষকদের মতে, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৯০% শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এবং এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে। আর শকুন হারিয়ে যাওয়ায় পশুর অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, জলাতঙ্ক, ক্ষুরা ইত্যাদি রোগ বাড়ছে। এ থেকে মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণায় প্রমাণিত, শকুনের পাকস্থলীতে থাকা বিশেষ ধরনের জারক রস অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, কলেরা, ক্ষুরা প্রভৃতি রোগের জীবাণু সহজেই হজম করে ফেলে, যা অন্য প্রাণীরা পারে না। তাই এসব রোগে কোনো প্রাণী মারা গেলে সেই মাংস খেয়ে প্রকৃতিতে রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকে দিত শকুন। আইইউসিএনের হিসেবে, আশির দশকে শুধু সার্কভুক্ত দেশগুলোতেই শকুন ছিল প্রায় ৪ কোটি। বর্তমানে তা কমে ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। পৃথিবীর প্রায় ৯০ ভাগ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শকুনের সব প্রজাতিকে ‘মহাবিপন্ন ঘোষণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া বছরে মাত্র একটি ডিম পাড়া, খাদ্য সংকট, বড় গাছ কেটে ফেলায় বাসস্থান সংকট, বৈদ্যুতিক তার ও বিষ প্রয়োগে হত্যা, মানুষের মধ্যে শকুন নিয়ে নানা কুসংস্কারের কারণে শকুন দেখলে তাড়িয়ে দেওয়া বা মেরে ফেলার প্রবণতাও শকুন বিলুপ্তিতে ভূমিকা রাখছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের অধ্যাপক লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় দেখতে পান, ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন ব্যবহারের পর কোনো পশু মারা গেলে সেই মৃত পশুর মাংস খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শকুন কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। ১৯৮০ দশকে ওষুধটি বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সস্তায় পাওয়া যায় বলে গবাদিপশুর প্রায় সব রোগেই এ ওষুধটি কৃষকরা ব্যবহার শুরু করেন। ফলে দলে দলে মারা যেতে থাকে শকুন।
পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে ২০১০ সালে আইন করে গবাদি পশুর জন্য ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৪ সালে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং খুলনার সুন্দরবনে বিলুপ্তপ্রায় শকুনের জন্য দুটি ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা হয়।
শকুন সংরক্ষণ অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৬-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়। এতে হবিগঞ্জ অঞ্চলে প্রজননে কিছু সাফল্য এলেও শকুনের সংখ্যা বাড়েনি। শুধু ২০২৩ সালের ২৩ মার্চে মৌলভীবাজারে একাটুনা ইউনিয়নের বুড়িকোনা গ্রামের একটি মাঠ থেকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ১৩টি শকুনের দেহাবশেষ উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। ঘটনাস্থল তল্লাশি করে একাধিক শিয়াল ও কুকুরের দেহাবশেষ এবং মাঠের এক পাশ থেকে বিষ টোপের দুটি কৌটা উদ্ধার করা হয়। এক রাতেই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ১৩ শকুন।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মৌলভীবাজারে এক দিনে শকুনের একটা কলোনি ধ্বংস করে দেওয়ার পর এর মোট সংখ্যা আরও কমে গেছে। বাংলাদেশে এখন শুধু বাংলা শকুন টিকে আছে। অন্য কিছু পরিজায়ী শকুন আসে, আবার চলে যায়। শকুন অনেক উপকারী। এই প্রাণীটিকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। নিষিদ্ধ ওষুধগুলো এখনো লুকিয়ে-চুপিয়ে বিক্রি হচ্ছে। শকুনের আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজারে শকুন হত্যায় কারা দায়ী? তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো জানি না। এসব ঘটনায় কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে ও সেটা প্রচার করতে হবে। বড় গাছ রক্ষা করতে হবে। শকুনের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। শকুন রক্ষা সত্যিই অনেক জরুরি।