২০২২ সালে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৩২০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যেই প্রায় ১০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য গ্যাস নির্গত হয়, যা বিশ্বের কিছু উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক নির্গমনের চেয়েও বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মাত্র তিন মাসেই পাঁচ বছরের কম বয়সি ১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর মারাত্মক শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ এবং ১ লাখ ৩৬ হাজার শিশুর ডায়রিয়ার ঘটনা নথিভুক্ত হয়...
বিশ্বজুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা। মুখোমুখি দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত-পাকিস্তান। ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। দুই বছর ধরে চলছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে সংঘাত। মাটিতে মিশে গেছে গাজা উপত্যকা। এ ছাড়া গৃহযুদ্ধ চলছে অন্তত ৩০টি দেশে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে ইরান-ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া/যুক্তরাষ্ট্র, চীন-তাইওয়ান/যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর মধ্যেও। এসব যুদ্ধে শুধু মানবিক বিপর্যয়ই ঘটছে না, ভয়াবহ দূষণের শিকার পৃথিবী। বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত গ্যাস। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি। ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। মারা যাচ্ছে পশুপাখি। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার (নাসা, ইউএনইপি, সিইওবিএস ও মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের পরিবেশগত মূল্যায়ন) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধের কারণে বাতাসে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ ও ১০ ছাড়াও নানা ক্ষতিকর উপাদান ছড়িয়ে পড়ে। স্কাড-বি’র মতো একটি মাঝারি ধরনের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে গড়ে ৩০-৫০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। বড় আকারের আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে ২০০ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যেখানে একজন মানুষের বার্ষিক গড় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ৪-৫ টন। টিএনটি বা আরডিএক্স জাতীয় বিস্ফোরক থেকে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন হয়। ধুলাবালি ও ধাতব কণা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্রের রোগে মারা যায় ছোট প্রাণী। ১৬০ থেকে ১৮০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ তৈরি করে, যা মানুষ ও প্রাণীর শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়। উচ্চশব্দে পাখি ও বন্যপ্রাণীর প্রজনন বন্ধ হয়ে যায়। বিস্ফোরণে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে সিসা, ক্রোমিয়াম, কপারসহ নানা ভারী ধাতু, যা দীর্ঘস্থায়ী দূষণ ঘটায়। ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ জলাশয়ে পড়লে জলজ প্রাণী মারা যায়। অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেট নামক রকেট জ্বালানি পানিতে মিশলে ক্যানসার ও হরমোনজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দেশটি। দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তার কারণে এখনো সেখানে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে।
যুদ্ধের পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ে কানাডায় অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুদ্ধে শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। যুদ্ধের বর্জ্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, বিস্ফোরক ও জ্বালানি ব্যবহার থেকে প্রচুর পরিমাণে বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ হচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যে। কিছু দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হলেও কার্বন দূষণের মতো এর ক্ষতিকর প্রভাব বহন করছে সারা বিশ্ব। যুদ্ধ না করেও আমরা ভুক্তভোগী।
তিনি বলেন, বেশি কার্বন দূষণ ঘটানো দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। যেসব দেশ কম কার্বন দূষণ ঘটায়, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার, তারা সেই ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়। যুদ্ধের কারণে যে দূষণ ঘটছে তার প্রভাবও সবাই ভোগ করছে। এজন্য শান্তিপ্রিয় দেশগুলো জাতিসংঘের কাছে যুদ্ধের কারণে তাদের ক্ষতির বিষয়টা তুলে ধরতে পারে। যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানাতে পারে। ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে।
তথ্যানুয়ায়ী, ২০২২ সালে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৩২০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যেই প্রায় ১০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য গ্যাস নির্গত হয়, যা বিশ্বের কিছু উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক নির্গমনের চেয়েও বেশি। বিস্ফোরণ ও গোলাবারুদের কারণে সাত শতাধিক শিল্প কারখানা, তেল ডিপো ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে, যার ফলে মারাত্মক বায়ু ও মাটিদূষণ হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে যুদ্ধ চলায় রেডিওঅ্যাকটিভ বিপদের ঝুঁকিও বেড়েছে। গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকার ৩০% পরিবেশগত অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পানি শোধনাগার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র ও গ্রিন জোন। মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে বাতাস, মাটি ও পানি।
পরিবেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে ১৯১৪-২০২৩ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশে করা ১৯৩ কেস স্টাডির তথ্য বলছে, এতে বনভূমি ধ্বংস (৩৪ শতাংশ) ও ভূমিক্ষয় (২৩ শতাংশ) ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মাত্র তিন মাসেই পাঁচ বছরের কম বয়সি ১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর মারাত্মক শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ এবং ১ লাখ ৩৬ হাজার শিশুর ডায়রিয়ার ঘটনা নথিভুক্ত হয়।
গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের বৃহত্তম সংঘাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শুধু যে ৪৬ হাজারের বেশি ইউক্রেনের সেনা নিহত হয়েছেন তা-ই নয়, বহু শহর ও গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। নাগরিকদের মতোই চরম দুর্দশায় পড়েছে সেখানকার পরিবেশও। বহু প্রজাতির অস্তিত্ব সংকটে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের হিসাব অনুযায়ী, ৩০ লাখ হেক্টরেরও বেশি অরণ্য সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত, যার মধ্যে ১০ লাখ হেক্টর অরণ্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল।