জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ক্রমেই বাড়ছে পরিবেশগত সংকট। প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে বাড়ছে দাবানলের মাত্রা ও তীব্রতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দাবানল উদ্বেগে ফেলেছে গোটা বিশ্বকে। গবেষণার তথ্য বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে দাবানলের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে। দাবানলের কারণে বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস। এতে আরও বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণতা। আর কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় সবচেয়ে তলানিতে বাংলাদেশের নাম থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দেশটি।
বিশ্বব্যাপী দাবানল বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টার্ন ফায়ার চিফস অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা না গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ দাবানলের হার অন্তত ১৪ শতাংশ বাড়বে, ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে এবং শতাব্দীর শেষে ৫০ শতাংশ বাড়বে। আর দাবানল বাড়লে কার্বন নিঃসরণ বাড়বে। এতে বৃদ্ধি পাবে তাপমাত্রা, যা দাবানলের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলবে। অন্যদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে গলবে মেরু অঞ্চলের বরফ। বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। সমুদ্রের লবণ পানি নদী-খাল দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে বিপর্যয় ঘটাবে কৃষির। এ ছাড়া গত বছর দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহ বিভিন্ন ফসলের ফলনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ইতিহাস বলছে, পৃথিবীতে দাবানলের সূচনা প্রায় ৪৩ কোটি বছর আগে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শীতের মধ্যে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ে ছাই হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় লস এঞ্জেলসের বেশির ভাগ জনপদ। সর্বাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার পরও ঠেকানো যায়নি আগুনের লেলিহান শিখা। এতে শুধু প্রাণহানি নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিপর্যস্ত। লাখ লাখ হেক্টর জমির গাছ পুড়ে শেষ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে কোটি কোটি প্রাণী। দাবানল থেকে সৃষ্টি হচ্ছে লাখ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড, যা বৈশ্বিক পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। গবেষণার তথ্য বলছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে দাবানল। আবার এই দাবানল বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। উভয়ের সম্পর্ক পারস্পরিক। শুধু তাপমাত্রা বাড়লে সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ে। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বাতাসে কার্বন নিঃসরণ।
হেনরিচ ফাউন্ডেশন ও ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট (আইএমডি)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে ব্রুনাই, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশ মাথাপিছু যতটুকু কার্বন নিঃসরণ করে, উন্নত দেশগুলো তার চেয়ে ১৫ থেকে ২৫ গুণ বেশি কার্বন বাতাসে ছাড়ছে। ব্রুনাই যখন মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ করছে ২০.৭ মেট্রিক টন, তখন বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ করছে শূন্য দশমিক ৬ মেট্রিক টন। অথচ, ২০১৯ সালে জার্মানওয়াচ নামের পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ৭টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা না গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এবং নাসাসহ ছয়টি জলবায়ু সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাপমাত্রায় ২০২৪ সালটি সব বৈশ্বিক রেকর্ড ভেঙেছে এবং প্রাক-শিল্প সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে উষ্ণতার চাদরে ঢাকা পড়ছে পৃথিবী। এটা দাবানল যেমন বাড়াচ্ছে, দাবানল মোকাবিলায় বাধা দিচ্ছে। দাবানল বৃদ্ধির পেছনে বজ্রপাতও অন্যতম ভূমিকা রাখছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের সংখ্যারও তীব্রতা বাড়ছে। এতে অনিয়ন্ত্রিত অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রাণ ও সম্পদহানির ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে এ বছর আজারবাইজানে কপ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন অংশীজনরা। তবে এখন পর্যন্ত এসব পরামর্শ শুধু মিটিং ও দলিলেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন বিশ্বনেতারা। ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বনেতারা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রাক-শিল্প সময়ের তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির ওপরে উঠতে দেবে না। কিন্তু ২০২৩ সালেই তা অতিক্রম করেছে। আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ কার্বন নির্গমন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো।