বাংলা ব্যান্ডসংগীতের উজ্জ্বল দশক নব্বইয়ের সেই দিনগুলোতে ছিল কিছু সুরের কারিগর, যাদের হাত ধরে উঠে এসেছিল ‘তাজমহল’, ‘জন্মভূমি’, ‘স্টারস’ কিংবা ‘হারান মাঝি’র মতো কালজয়ী অ্যালবাম। সেই মায়াভরা সময়ের পেছনে যিনি ছিলেন এক নীরব স্থপতি-তিনি আশিকুজ্জামান টুলু।
টুলুর গল্প : গীতিকবি, গায়ক ও সুরস্রষ্টা
ছোটবেলায় বাবার কাছে সুর শেখার বয়সে তিনি দেখতেন ফেরদৌসি রহমান বা আবদুল আলীমের মতো কিংবদন্তিদের আনাগোনা। বাবার মৃত্যুর পর উদীচীর মঞ্চে কখনো তবলা, কখনো বঙ্গ বাজিয়ে শুরু হয় টুলুর সংগীতযাত্রা। ধীরে ধীরে গিটার, ড্রাম, কিবোর্ড-সবকিছুতেই হয়ে ওঠেন পারদর্শী। এরপর তৈরি করেন ইতিহাস-‘চাইম’ থেকে ‘আর্ক’। তার হাতে সৃষ্টি হয় একের পর এক অমর গান। যেমন ‘আমার হৃদয়ে তুমি’। গানটি লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন টুলু। ‘হেসে খেলে এই মনটা আমার’, গানটি কাউসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এবং মাকসুদের গাওয়া গান। টুলু সুর করেছিলেন। সাঈফের লেখা ও টুলুর সুরে ‘ভেবো না এই কান্না’ (নকিব খান), আহমেদ ইউসুফ সাবেরের লেখা ‘নিজেই নিজের কাছে গল্প বলে’ (নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী), সিজান মাহমুদের লেখা ‘কোনো এক সুন্দরী রাতে’ (সামিনা চৌধুরী), সোহেল আরমানের লেখা ও সুর করা ‘নয়নে নয় তবু কাঁদে হৃদয়’ (শামীম), আসিফ ইকবালের লেখা ও সৌমেন্দ্র শংকর দাসের সুরে ‘নিঝুম রাত জেগে আছে’ (টুলু), অটোমনাল মুনের লেখা এবং সুরে ‘তুমি অন্তর নিয়ে খেলতে ভালোবাসো (টুলু), লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা ও টুলুর সুরে ‘তুমি আমার প্রথম সকাল’ (শাকিলা জাফর-তপন চৌধুরী), তুহিন আখন্দের লেখা ও টুলুর সুরে ‘আকাশ ঢেকে রাখে’ (টুলু)।
ওরে আমার পাগল মন : পঞ্চমের প্রথম টিউন
গানটির পেছনের গল্পটা রীতিমতো মজার। কথিত আছে, পঞ্চমের বাসার কাজের বুয়ার লেখা! তবে সেই ভুলটা ভাঙলেন রেদওয়ান নবী পঞ্চম নিজেই। তিনি বললেন, ‘গানটি ১৯৮৭’তে লেখা। আমার প্রথম টিউন করা। গানটি নিয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আমি তখন সুমা আপার বাসায়। রাসেলের সঙ্গে গিটার নিয়ে বসা। সুমা আপার বাসায় কাজ করত একজন বয়স্ক বুয়া; সবসময় পান খায়। তো, হঠাৎ করে সে কাজ করতে করতে গেয়ে উঠল, ‘ওরে আমার পাগল মন, চিন্তা ভাবনা কইরা তুমি দিও তোমার মন’। কথাগুলো সে অবিরত বলতে থাকল। তখনই এটি গিটারে টিউন করলাম। এরপর গানটির অন্তরাও লেখা হলো, যার প্রথম অন্তরা লিখেছিলেন আমার দুলাভাই ইজাজ খান স্বপন আর দ্বিতীয় অন্তরা আমার লেখা। সুর আমার। আর গানটি গেয়েছিলেন টুলু ভাই।’ তবে সেই ফিতা-ভরা গানই হয়ে গেল আর্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় হিট! এই গানটিকে সবাই পঞ্চমের গান বলেই ডাকে।
হাসান : ভক্তিময় গলার রকস্টার
‘তাজমহল’ অ্যালবামের সময় মানে ১৯৯৩ সালের দিকে পঞ্চমই টুলুর কাছে নিয়ে আসে হাসানকে। টুলু মনে করে বলেন, ‘ওর গলায় একেবারে পল্লীগীতি, কিন্তু আবার ওয়েস্টার্ন টাচও আছে, একেবারে ইউনিক ভয়েস।’ সেই ভয়েস দিয়েই জন্ম নেয় ‘সুইটি তুমি আর কেঁদো না’, ‘আমি একাকী’, ‘গুরু তোমার এমন বাণী’। ‘আমি একাকী’, ‘যারে যা উড়ে যা’ ও ‘সুইটি’ গানগুলো হাসানের লেখা ও সুর করা।
পঞ্চম : কিশোর থেকে কিংবদন্তি
আর্কে যোগ দেওয়ার আগে কিশোর পঞ্চম টুলুর চাইম ব্যান্ডে ছিল। ছোট্ট এক কিশোর, সামিনা-ফাহমিদার ভাই, যাকে টুলু বলেছিলেন, ‘বয়সে ছোট হলেও ফিট হলে ব্যান্ডে আসবি।’ সেই পঞ্চমই পরে গায় বাপ্পী খানের লেখা ও টুলুর সুর করা ‘এমন একটা সময় ছিল’- আর গানটি আজও বাজে নস্টালজিয়ার তরঙ্গে। পঞ্চম বলেন, ‘গানটি ৯১ সালে করা। বন্যা আপার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। বলা যায়, টুলু ভাইকে ঠ্যাক দিয়ে গানটি করা।’ তার গাওয়া আরও গান ‘আকাশের নীলে’, ‘ও ময়না তুই’, ‘হারালে কোথায়’।
গানের মতো দূর পরবাসে তারা গুনছেন টুলু
টুলুর জীবন মানেই গান। ‘এই দূর পরবাসে’-গানটি লিখেছিলেন আসিফ ইকবাল। লেখার পর ১৯৯৬ সালে টুলু সুর করেন। মানে দেশ ছাড়ার আগে, কানাডা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে। পরে প্রবাসে গিয়ে টুলু বুঝেছিলেন, গানটা আসলে তারই আত্মজীবনী।