রোমান্টিক আর অ্যাকশন ঘরানার গল্প থেকে এখনো বের হতে পারছে না ঢাকাই ছবি। অথচ একটি সফল কমেডি, সায়েন্সফিকশন বা ফোকধর্মী সিনেমা যে চলচ্চিত্র নির্মাণের সব লক্ষ্য পূরণ করতে পারে- বিষয়টি যেন উপলব্ধিতে আনতে পারেন না এ সময়ের চিত্রনির্মাতারা। একটা সময় কমেডি ছবি ‘হাবা হাসমত’, ‘দিলদার আলী’, ‘মনা পাগলা’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ কিংবা ফোক ঘরানার ‘রূপবান’, ‘সাতভাই চম্পা’, ‘বেহুলা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাস বদলে দিয়ে নতুন ধারার সূচনা করেছিল- তা আজও স্বীকৃত।
আমাদের চলচ্চিত্রের শুরুটা ছিল অনেকটা অ্যাকশন ঘরানার ছবির মাধ্যমেই। ১৯৫৬ সালে প্রথম সবাক ঢাকাই ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ‘মুখ ও মুখোশ’। ছবিটির নির্মাতা আবদুল জব্বার খান রচিত ‘ডাকাত’ নাটক অবলম্বনে নির্মিত হয়। একজন ডাকাতের দুর্ধর্ষতার গল্প নিয়ে প্রায় অ্যাকশন ধাঁচে গড়ে ওঠে ছবির গল্প। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় রোমান্টিক গল্পের ছবি নির্মাণ। সত্তর দশকে এসে রুহুল আমিন পরিচালিত রাজ্জাক-কবরী অভিনীত ‘রংবাজ’ চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু হয় অ্যাকশন ধারার গল্পের ছবি তৈরি। বলতে গেলে আশির দশক পর্যন্ত ঢাকাই চলচ্চিত্র রোমান্টিক আর অ্যাকশন ঘরানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। রোমান্টিক ধারার সিনেমা চলাকালীন কিন্তু রাজ্জাকের অ্যাকশনধর্মী ‘রংবাজ’ সিনেমাটি দর্শক খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করে। তারপরও রাজ্জাক-পরবর্তী আলমগীর, বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানা, ফারুকদের সময়েও ইন্ডাস্ট্রির ঝোঁক ছিল রোমান্টিক ধারার দিকে। এক সময় রোমান্টিক ধারা যখন দর্শকের কাছে একঘেয়েমি মনে হলো, তখন ইন্ডাস্ট্রি বুঝতে পারল ধারা পরিবর্তন করতে হবে। তখনই শুরু হলো অ্যাকশনধর্মী ছবি নির্মাণ। স্বভাবতই রোমান্টিক ধারার অনেক নায়ককে বিদায় নিতে হলো। চলচ্চিত্রের ইতিহাস খুঁজলে এরকম তথ্য মেলে- কেবল ধারা পরিবর্তনের কারণেই শুরু থেকে অদ্যাবধি অনেক নায়ককে চলচ্চিত্র থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। ওয়াসিম, জসিম, রুবেল অ্যাকশনধর্মী সিনেমা করে যখন নিজেদের একটা অবস্থানে নিয়ে গেছেন তখনই আগমন ঘটল সালমান শাহর। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ আর সালমান শাহর মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি আবারও অ্যাকশন থেকে বেরিয়ে রোমান্টিক ধারায় প্রবেশ করে। এতে আবার অ্যাকশনধর্মী নায়ক জসিমদের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। সালমান শাহর মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত চলচ্চিত্র অ্যাকশনধর্মীতেই রয়ে গেছে। এতে সালমান শাহর পর রোমান্টিক কোনো নায়ক তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। রিয়াজ, ফেরদৌসরা রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে থাকলেও তারা সালমান শাহর জনপ্রিয়তা ছুঁতে পারেননি। এর ফাঁকে অবশ্য নব্বই দশকে মান্না অ্যাকশন ধাঁচের ছবি নিয়ে এক শ্রেণির দর্শক মাতাতে থাকেন। তারপরও মান্না কিন্তু জসিম ও ওয়াসিমের মতো অ্যাকশন নিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি।
এ দেশের ছবির নায়করা অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে সীমিত না থাকলেও রোমান্টিক ধাঁচের নায়করা অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র করতে পারেন না বলেই চলচ্চিত্রকারদের অভিমত। কারণ হিসেবে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একই সময়ে দুটি বা তার অধিক কোনো ধাঁচ ছিল না। যে কোনো একটি ধাঁচের সিনেমা দীর্ঘসময় টিকে থাকত। এতে একজন নায়ককে একই ধাঁচে দেখতে দেখতে দর্শক অভ্যস্ত হয়ে যেত। হঠাৎ করে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটলে দর্শক তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করত না। যে সমস্যাটি বর্তমানে হচ্ছে টিভি নাটকের নায়কদের ক্ষেত্রে। অনেক টিভি নায়কই এখন পর্যন্ত চলচ্চিত্রে এসেছেন কিন্তু কেউ-ই তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। কারণ ওই একটাই- দর্শক তাদের অন্যভাবে দেখে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই ঢাকাই ছবিতে যদি একই সঙ্গে বিভিন্ন ধারার গল্পের ছবি নির্মাণের প্রচলন থাকত তাহলে একজন নায়ক সব ধারায় অভিনয় করে দর্শক মন জয় করতে পারত। তাহলে কোনো নায়ক নতুন ধারা এলে ‘বাতিল’ হয়ে যেত না। আসলে চলচ্চিত্র হচ্ছে একই সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসা দুটোই। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি শুরু থেকে অদ্যাবধি দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রথমটিকে প্রচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ব্যবসা ব্যাহত করে শিল্প ঠিক রাখার মানসিকতা এখন পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রি দেখাতে পারেনি। বরং তাদের উল্টো মনোভাবটাই বেশি চোখে পড়ে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পুরো চলচ্চিত্র শিল্পের ওপরই পড়েছে। তাই আমাদের এই প্রধান গণমাধ্যমটির ‘প্রধান’ না হয়ে ওঠার পেছনে যা দায়ী তা হলো-
ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেওয়া, কেবল দুটি ধারাতেই বারবার আসা-যাওয়া, জনপ্রিয় নায়ক দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা, রোমান্টিক ও অ্যাকশন হিরো ভাগ করা এবং নায়িকাকে উপেক্ষা করা প্রভৃতি। এখন আরও একটি ধারা চলছে, আর তা হলো শাকিব খান ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রে আর কোনো নায়ক নেই। কিন্তু শাকিবের পাশাপাশি আরও রাজ্জাক, সালমান শাহ তৈরি করার চেষ্টা কোনো নির্মাতা করছেন না। এটি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী চিন্তা।