শোবিজ তারকারা অভিনয় করে শুধু মানুষকে হাসায়-কাঁদায় না। তাদের জীবনেও আছে মজার যত হাসি-কান্নার গল্প। কয়েকজন কিংবদন্তি তারকার এমন কিছু গল্প তুলে ধরছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
অন্যরকম নায়করাজ
স্কুলজীবন থেকেই অভিনয়ের পোকা মাথায় ঘুরত রাজ্জাকের। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে জহির রায়হানের সহকারী হিসেবেও কাজ করা শুরু করলেন তিনি। জহির রায়হান তখন বিখ্যাত লোকগল্প ‘বেহুলা’ বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নায়িকানির্ভর এই ছবিতে নায়ক লখিন্দরকে অধিকাংশ সময় শবদেহ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। তখনকার নামকরা কোনো নায়কই এ চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন না। জহির রায়হানের জহুরি চোখের নজর পড়ল রাজ্জাকের ওপর। রাজ্জাক প্রথম নায়ক হওয়ার সুযোগ পেলেন বেহুলা ছবিতে। আর প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। আরেকটি ছবি নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’-এ রানা মামা চরিত্রে ববিতার মামা হন তিনি। ববিতার প্রেমিক হিসেবে এ ছবিতে অভিনয় করেন ফারুক। রাজ্জাক চাইলেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন, কিন্তু ভিন্নতার জন্যই তিনি মামার চরিত্রটি বেছে নেন। ১৯৭৪ সালে চিত্রনায়ক সোহেল রানার ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে ক্লাবের গায়ক হিসেবে একটি দৃশ্যে অভিনয় করেন রাজ্জাক। গানটি ছিল ‘মনেরই রঙে রাঙাব’। নতুন একজন পরিচালক-নায়কের ছবিতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা নায়ক রাজ্জাকের এমন ভিন্ন একটি চরিত্র করা অসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
ডাক্তার হতে পারলেন না ববিতা
ববিতা বলেন, ‘মনে পড়ে একবার আমার অভিনীত একটি সিনেমা হলে দেখতে গিয়ে দর্শকের কাছে ধরা পড়েছিলাম। আমি বোরকা পরে মুখ ঢেকে সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। মুখ ঢাকা থাকলেও হাত তো আর ঢাকা থাকত না। এক দর্শক আমার হাত দেখেই বুঝে ফেলেছিলেন যে আমি ববিতা। পরবর্তী সময়ে আমাকে একনজর দেখার তার আকুতি-মিনতির কাছে আমি হার মেনে যাই। মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে হয়। যদিও বিষয়টা আমার কাছে ভীষণ উপভোগ্য ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার একটা ভয়ও ছিল। পুরো প্রেক্ষাগৃহে জানাজানি হলে তো বিপদ। অবশেষে বের হতে পেরেছিলাম। কিন্তু এরপর থেকে আমার আর সিনেমা হলে যাওয়া হয়নি।’ ক্ষণজন্মা চলচ্চিত্রকার ও কথাশিল্পী জহির রায়হানের নায়িকা হয়েই চলচ্চিত্রে পা রাখেন ববিতা। এই বিখ্যাত পরিচালক একদিন বললেন, ‘পপি, আমার সিনেমায় তোকে টিনএজ মেয়ের একটি ক্যারেক্টার করতে হবে।’ ছবিটির নাম ‘সংসার’। কিন্তু ববিতা বেঁকে বসলেন। তাঁর মা-বোন খুব বোঝালেন। সিনেমায় নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর বাবা, আর বড় বোন সুচন্দা মা। অবশেষে রাজি হলেন। এরপর ডাক্তার হওয়ার লক্ষ্যে আবার তাঁর পুরোনো জীবন শুরু হলো। একটি সিনেমা করে ফেলার পরও অভিনেত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। ‘সংসার’-এর বছর দুয়েক পর জহির রায়হান পরের ছবি ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’তে হাত দিলেন। নায়িকা শবনমের শিডিউল পাওয়া যাচ্ছিল না। ছবির প্রযোজক বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী জহির রায়হানকে বললেন, ‘এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? তোমার ঘরেই তো নায়িকা আছে।’ এরপর আবারও প্রস্তাব ও ববিতার প্রত্যাখ্যান। আগের মতোই সবাই মিলে তাঁকে বোঝাল। শেষ পর্যন্ত এটাই শেষ সিনেমা- এমন শর্তে রাজি হলেন। তাঁর বিপরীতে ছিলেন নায়ক নাদিম। তখন তাঁর নাম ফরিদা আক্তার পপিই আছে। ববিতা হয়নি। চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী আর তাঁর স্ত্রী মিলে ফরিদা আক্তার পপির নাম বদলে দিলেন ববিতা। ফলে আর ডাক্তার হতে পারলেন না ববিতা।
পোলাও খেতে গিয়ে আর্মির কবলে ফারুক
জীবদ্দশায় চলচ্চিত্রের মিয়াভাই-খ্যাত ফারুক তাঁর জীবনের অনেক গল্প বলে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধের তিন মাসের মাথায় একবার আমার খুব ইচ্ছা হলো পোলাও খাব। রাস্তায় তো বের হওয়া সম্ভব হয় না। আমার এক ছোট ভাই বলল ‘আমি নিয়া আসি।’ আমি বললাম নিয়া আসবি? কিন্তু গিয়া খাইতে পারলে ভালো লাগত গরম গরম। ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘চলেন কোনো অসুবিধা হবে না।’ তার সঙ্গে খেতে গেলাম নবাবপুর রোডের আল-ইসলামিয়া হোটেলে। আমরা খেতে ঢোকার পর হোটেলে গান লাগাল ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’। একটু পর দুটো জিপ এসে হোটেলের নিচে থামল। সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে গান পাল্টিয়ে পাঞ্জাবি এক গান লাগানো হলো ‘সাব তো সোনিয়া হ্যায়রে মান মোরিয়া’। আর্মি ঢুকেই একটা লাথি দিয়ে ক্যাশে থাকা লোকটাকে ফেলে দিয়ে বলল- ‘মাঝি বাইয়া যাও রে? বাড়ি ক্যাথায়? ফেরিদপুর? নাম ক্যায়া হ্যায়? শেখ মুজিব? শালা শুয়ার কা বাচ্চা আভি তুম ক্যায়া বাজায়া? মাঝি বাইয়া যাও রে?’ আমরা ভিতরে কেবিনে বসে খাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম সেখানেই বোধহয় মৃত্যু হবে, বেঁচে ফিরতে পারব বুঝতে পরিনি। কিছুক্ষণ পর ওদের সামনেই ‘সাব তো সোনিয়া হ্যায়রে মান মোরিয়া’ গাইতে গাইতে বের হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গের ছেলেটা সাদা লুঙ্গি আর টুপি পরা ছিল, ওরা ভাবছিল হয়তো নামাজ পড়ে খেতে ঢুকেছিলাম। ওইখান থেকে বের হয়েই চটজলদি এলাকা পার হয়ে গেছি।
সোহেল রানা কেন চলচ্চিত্রে
১৯৬১ সালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন মাসুদ পারভেজ। তখন তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করেন। দেশ স্বাধীনের পর চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এলেন তিনি। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবি দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে সোহেল রানা, তাঁর বন্ধুরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন, কী করবেন? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। তাঁরা ভাবলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সেই ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম লেখালেন মাসুদ পারভেজ। শুরুটা ঠিকই ছিল তাঁর। মাসুদ রানা নামেই প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি। কিন্তু পরে হয়ে গেলেন নায়ক। মজার ব্যাপার হলো ‘মাসুদ রানা’ ছবির প্রধান চরিত্রের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। চরিত্র নির্বাচনের জন্য এস এম শফি, সুমিতা দেবী, মাসুদ পারভেজ আর আহমেদ জামান চৌধুরীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। সারা দেশ থেকে অনেকেই ছবি পাঠালেন মাসুদ রানা চরিত্রটির জন্য। কিন্তু এস এম শফি, সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরী হঠাৎ এক দিন মাসুদ পারভেজকে বললেন, ‘তুমিই হবে মাসুদ রানা।’ আহমেদ জামান চৌধুরী তখনই নায়ক হিসেবে তাঁর নাম ঠিক করলেন সোহেল রানা। এ ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা তাঁকে পর্দায় দেখতে পান ১৯৭৪ সালে।