চলচ্চিত্রের যখন জন্ম, তখন অনেকে চিন্তাই করেননি- এ অঙ্গনের অন্যতম চালিকাশক্তি হবেন নারীরা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই নারীরা এগিয়ে আসেন চলচ্চিত্রের প্রধান চালিকা হিসেবে। ক্যামেরার পেছনেও প্রমাণ করেছেন নিজেদের মেধা। বিষয়টি তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
বিশ্বে প্রথম অ্যালিস
ফরাসি নারী অ্যালিস গি-ব্লাশি স্বপ্ন দেখেছিলেন সিনেমা তৈরির। সেই স্বপ্নের পথে তার প্রথম পদচিহ্ন ছিল ১৮৯৬ সালের নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য ক্যাবেজ ফেইরি’। ইতিহাসে একেই ধরা হয় প্রথম চলচ্চিত্র যার দৈর্ঘ্য ছিল পুরো এক মিনিট। পরের এক দশক ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে আরও অনেক নির্বাক চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন অ্যালিস।
হলিউডে ডরোথি আর্জনার
হলিউড বিশ্বের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ডরোথি আর্জনার। এর কারণ হলিউডের ‘গোল্ডেন এজ’ চলাকালীন তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী পরিচালক, যার হাত ধরে সিনেমার ইতিহাস এগিয়েছে বহুদূর। বলা যায়, তৎকালীন সিনেমায় শব্দের প্রবর্তন তার অবদান। তবে তার ক্যারিয়ারের শুরু স্টেনোগ্রাফার এবং পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে, যদিও শেষ পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনটি সাইলেন্ট ফিল্ম তৈরির পাশাপাশি তিনি ১৪টি টকিজ তৈরি করেন।
চীনে তাজুকো সাকানি
জীবনের বিভিন্ন স্তরে অবজ্ঞা, অবহেলা এমনকি হয়রানিকে পেছনে ফেলে তাজুকো বিশ্বের প্রথম মহিলা ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৩৬ সালে ৩২ বছর বয়সে তিনি তৈরি করেন তার প্রথম সিনেমা ‘হাতসু সুহাতা’। মাঞ্চুরিয়ায় আক্রমণকালে তিনি উত্তর-পূর্ব চীনে ডকুমেন্টারি এবং প্রচারমূলক বেশ কিছু ছবিও তুলেছিলেন।
আমেরিকায় লুসি ওয়েবার
লুসি ওয়েবার হলেন প্রথম আমেরিকান নারী চলচ্চিত্র পরিচালক। অ্যালিস গিয়ের স্বামী হারবার্টের মাধ্যমে ১৯০৮ সালে তিনি প্রথমে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ লাভ করেন। তার স্বামী ফিলিপস মলির সহযোগিতায় তিনি একজন সফল নারী নির্মাতা হয়ে ওঠেন। তিনি তার জীবদ্দশায় এক শরও বেশি সিনেমার নির্দেশনা দেন যার বেশির ভাগ সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নৈতিকতার শিক্ষা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ফাতমাহ বেগম
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম নারী পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন ফাতমাহ বেগম। অভিনয়ের চেয়ে তাকে সিনেমার দিকনির্দেশনা দেওয়াটাই বেশি আকর্ষণ করত। তাই ১৯২৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজস্ব প্রযোজনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফাতমাহ ফিল্মস’ এবং নির্মাণ করেন ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নারী পরিচালিত সিনেমা ‘বুলবুল-ই-পারিসতান’।
মধ্যপ্রাচ্যে সামিরা মাখমালবাফ
মুসলিম সমাজব্যবস্থায় রক্ষণশীলতার বেড়া ডিঙিয়ে নারীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনই অনেক সময় হয় বাধার সম্মুখীন, সেখানে চলচ্চিত্রের নির্দেশনায় আসবে নারীরা- এককালে এ ছিল দিবাস্বপ্নের মতোই ব্যাপার। কিন্তু ইরানের রাখসান বনি-এতিমাদ প্রথমবারের মতো স্বপ্ন দেখেন একজন মুসলমান নারী হয়েও সেলুলয়েডের ফিতায় নিজের কল্পনাগুলোকে বাঁধতে। সেই ধারায় ইরানে নারীদের প্রতিনিধি হয়ে সাফল্যের সঙ্গে সিনেমা নির্মাণ করেন সামিরা মাখমালবাফ। খ্যাতিমান চিত্রনির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফের সুযোগ্য এই কন্যা মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম ছবি ‘দ্য অ্যাপল’ দিয়ে জিতে নেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি অ্যাওয়ার্ড। সৌদি আরবে সিনেমা তৈরির স্বপ্ন দেখতেন হাইফা আল মনসুর। তার হাতেই তৈরি হয় প্রথম নারী নির্মিত সিনেমা ‘ওয়াজদা’।
বাংলাদেশে রেবেকা
বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। এর প্রায় ১৩ বছর পর ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ নামে একটি চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হয়েছিল। এটিই এ দেশের প্রথম নারী চিত্রনির্মাতা নির্মিত চলচ্চিত্র। সেই নারী হলেন রেবেকা। তিনি বেঁচে নেই। ২০০৬ সালে মারা যান এই চিত্রনির্মাতা ও অভিনেত্রী। রেবেকার প্রকৃত নাম মনজন আরা বেগম। ১৯৭০ সালে ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ পরিচালনা করেন তিনি।
অস্কারে লিনা ওয়ার্টমুলার
লিনা ওয়ার্টমুলার, ‘সেভেন বিউটিস’ (১৯৭৫), প্রথম নারী পরিচালক, যিনি অস্কারে সেরা নির্মাতার মনোনয়ন পেয়ে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। আর সেটি ১৯৭৬ সালে অস্কারের ৪৯তম আসরে। ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা লিনা ওয়ার্টমুলার তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ‘সেভেন বিউটিস’-এর জন্য সেরা পরিচালকের মনোনয়ন পান। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে বেশ বড় প্রভাব রাখেন তিনি। ২০২১ সালে মারা যান এই নির্মাতা।