যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন! যাঁর কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ ছোটেনি,
জামাতে নামাজের তাকবিরে উলা ছোটেনি, আসরের সুন্নত নামাজ ছোটেনি, কখনো পরনারীর কল্পনা হৃদয়ে উদিত হয়নি।
হ্যাঁ, তিনিই শামসুদ্দিন আল-তামাস বা ইলতুতমিশ (জন্ম ১১৮০ খ্রি.-মৃত্যু ১২৩৬ খ্রি.)।
দিল্লির মামলুক সালতানাতের
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
ক্রীতদাস হতে বাদশাহ যিনি;
কাজা করেননি নামাজও তিনি।
তাঁর উপাধি ‘সুলতান-ই-আজম’। ইউসুফ (আ.)-এর মতো তিনি ছিলেন সুদর্শন। গুণাবলি ও জীবনাল্লেখ্যে তিনি অনেকটাই ছিলেন নবী ইউসুফ (আ.)-এর সদৃশ। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘তাবাকাত-ই নাসিরি’র লেখক কাজি মিনহাজি সিরাজি ইলতুতমিশের
রূপমাধুর্যের কারণে তাঁকে নুরের (জ্যোতি) সঙ্গে তুলনা করেন।
ইলতুতমিশের ভাইয়েরা তাঁর সৌন্দর্য ও যোগ্যতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তাঁকে কিনে নেন বুখারার কাজি সদরজং। পরে তিনি বিক্রি হয়ে যান ব্যবসায়ী হাজি বুখারির কাছে; পরে বিক্রি হন জালাল উদ্দিন চোস্তকবার কাছে। বুখারায় ইলতুতমিশ ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
এরপরে তাঁকে কিনে নেন ভারতে মুসলিম শাসনের স্থপতি কুতুব উদ্দিন আইবেক। তাঁর যোগ্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে কুতুব উদ্দিন আইবেক তাঁকে সার-জান্দার (chief of guard regiment) নিযুক্ত করেন। কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা তিনি আমির-ই-শিকার এবং পরে গোয়ালিয়রের আমির হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। কুতুব উদ্দিন আইবেক তাঁর কন্যাকে ইলতুতমিশের সঙ্গে বিয়ে দেন এবং তাঁকে বাদাউনের জায়গির নিযুক্ত করেন।
১২১০ খ্রিস্টাব্দে কুতুব উদ্দিন আইবেকের মৃত্যু হয়।
১২১১ খ্রিস্টাব্দে ইলতুতমিশ দিল্লির সুলতান মনোনীত হওয়ার পরই ইলতুতমিশ নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। যেমন—গজনির শাসক তাজউদ্দিন ইলদুজ ভারতের ওপর নিজ সার্বভৌমত্ব দাবি করেন।
দিল্লি, বদাউন, অযোধ্যা, বারানসি প্রভৃতি স্থানের আমিররা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
সিন্ধু ও পাঞ্জাবের শাসক নাসিরুদ্দিন কুবাচা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
তৎকালীন বাংলার শাসক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
আজমীর, গোয়ালিয়র প্রভৃতি স্থানের রাজপুতরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
ইলতুতমিশ ছিলেন প্রাজ্ঞ শাসক। তিনি দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষদের পরাজিত করেন। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি খিলজি বংশের শাসককে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন। তিনি সিন্ধুর সুম্রাশাসকদের পরাজিত করেন। ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে ইলতুতমিশ গোয়ালিয়রের কেল্লা অবরুদ্ধ করেন। গোয়ালিয়রের শাসক এক বছর পর পলায়ন করলে ইলতুতমিশ গোয়ালিয়র দখল করেন। ইলতুতমিশ মালওয়া, বিলসা, উজ্জান দখল করেন এবং দক্ষিণে তাঁর সাম্রাজ্য নারবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ইলতুতমিশের শাসনামলে কুখ্যাত চেঙ্গিস খান হয়ে ওঠেন চরম হিংস্র ও দারুণ সম্প্রসারণবাদী। এ সময় ইলতুতমিশ তাঁর নব্য মুসলিম সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিস খানের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সুরক্ষা দেন।
ইলতুতমিশ দিল্লির সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রচলন করেন। ভারতবর্ষে রৌপ্যমুদ্রা বা তঙ্কা (১৭৫ গ্রাম) ও তাম্রমুদ্রা বাজিতল প্রবর্তন করেন। ইলতুতমিশের শাসনামলে আব্বাসীয় খলিফা মুনতানজির বিল্লাহ ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে বিপুল বিনিয়োগ করেন এবং তিনি ইলতুতমিশকে উপাধি দেন ‘সুলতানুল হিন্দ’।
ইলতুতমিশ আজমিরে মসজিদ নির্মাণ করেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি বখতিয়ার কাকিকে দিল্লিতে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে আজমির চলে যান। ‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজি’ গ্রন্থে রয়েছে, মৃত্যুর আগে বখতিয়ার কাকি ওয়াসিয়ত করেন, ‘আমার জানাজা যে পড়বে তার চারটি গুণ থাকতে হবে...!’
ইলতুতমিশ ওই চারটি গুণে গুণান্বিত ছিলেন, তিনি এগিয়ে গিয়ে বখতিয়ার কাকির কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘ওগো আল্লাহর বন্ধু। সারা জীবন নিজে আমল করে করে; তোমার আমল গোপন রেখে, আজকে আমার আমল প্রকাশ করে দিলে! আমি ভয় করি; আমার আমলগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় নাজানি আমি ধ্বংস হয়ে যাই।’
দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেক নির্মিত ‘কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদে’র (ইসলামের শক্তিকেন্দ্র) মিনারের শিলালিপিতে আছে—‘সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ছায়া পূর্ব থেকে পশ্চিমে ফেলার জন্যই এই মিনার নির্মাণ করা হয়।’ বিশিষ্ট সুফি সাধক সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামানুসারে নির্মিত কুতুব মিনারের কাজ ইলতুতমিশের সময়েই শেষ হয়। এ কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ প্রাঙ্গণেই অনন্ত বিশ্রামে আছেন দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন আল-তামাস (ইলতুতমিশ)। তাঁরই কন্যা সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়া।
(তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য।)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর