রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে গতকাল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় স্কুলটিতে ক্লাস চলছিল। যুদ্ধবিমানটি আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুলভবনটিতে আগুন ধরে যায়। এতে শিক্ষার্থী, বিমানের একমাত্র পাইলটসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। আগুনে পোড়া আহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই গুরুতর। এদের বার্ন ইনস্টিটিউটসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বিমানবাহিনী।
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সন্তানদের খোঁজে বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনরা ছুটতে থাকেন স্কুলের দিকে। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দেয়। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন উদ্ধারকর্মীরা। ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের গগনবিদারী আর্তনাদ আর দিগি¦দিক ছুটে চলায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে। দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বিধ্বস্ত প্লেনের অংশবিশেষ দেখে বোঝা গেছে, বিমানটি স্কুলভবনের সামনে পড়ে ছিটকে ভবনের সিঁড়ির সামনে চলে যায়। আর এর দুটি পাখার আঘাতে ধ্বংস হয় শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ দুটি ক্লাসরুম। আক্রান্ত ওই দুই কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্কুলের দারোয়ান জানান, ওই ভবনে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। সেটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। আইএসপিআর বলেছে, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। স্কুলের একটি একাডেমিক ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দুর্ঘটনার পর সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিস। স্থানীয় হাজারো মানুষ তাদের সহযোগিতা করে। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারসহ বিভিন্ন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আহত-নিহত ব্যক্তিদের নিকটস্থ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। ঘটনাস্থলে দেখা যায়, মাইলস্টোন কলেজের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কলেজের বিধ্বস্ত ভবন থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স বের হচ্ছে। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিদের জন্য রক্ত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। দুর্ঘটনার পর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকট দেখা দেয়। আহত ব্যক্তিদের রক্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ঘটনাস্থলে মাইকিং করা হয় রক্তের জন্য। সাধারণ মানুষও তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রক্ত দিতে শুরু করে। হাসপাতালে আহত-নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

বিকাল পৌনে ৫টার দিকে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, আজ বিমান বাহিনীর একটি এফ-সেভেন বিজেআই ফাইটার এয়ারক্র্যাফট আনুমানিক একটার দিকে আমাদের মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুলভবনে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে। এই দোতলা ভবনের প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বাচ্চাদের ক্লাস। দ্বিতীয় তলায় ছিল দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। তার সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপালের (অধ্যক্ষের) অফিস মিটিং রুম। একটা কোচিংয়ের ক্লাস চলমান ছিল। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং যখন হয়, তখন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল এবং ওই সময় যে জায়গায় টিচার্স রুমের সঙ্গে যে ল্যান্ডিং হয়, আঘাত করে, ওই জায়গায় বাচ্চাকাচ্চারা জড়ো হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে হয়তো কিছু অভিভাবকও ছিল।’ ফায়ার ফার্ভিস আনুমানিক বেলা ১টা ৮ মিনিটে দুর্ঘটনার খবর পায় জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘দ্রুত আমাদের ইউনিট পৌঁছে যায় এবং উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। আমাদের মোট ৯টা ইউনিট এখানে কার্যক্রম করেছে। বর্তমানে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ অবস্থায় আছে এবং আমরা উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছি।’ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, বিমানটি একটি ভবনের গেটে আছড়ে পড়ে। সেটি একাডেমিক ভবন। সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের ক্লাস চলছিল। আগুনে অনেকেই সেখানে দগ্ধ হয়েছে।
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে উপস্থিত এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে আমাদের কতজন শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছে, আমি তার খোঁজখবর নিতে এসেছি। যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয় সেখানে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। তবে ক্লাস শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ছুটি হওয়ার পর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তখন সেখানে কোচিংয়ের ক্লাস চলছিল। ভিতরে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। অনেকে হতাহত হয়েছে।’
রাষ্ট্রপতির শোক : রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।
ভবনটিতে চলছিল কোচিং ক্লাস : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার হল নামের যে ভবনটিতে বিমান আছড়ে পড়ে, সেই ভবনে তখন চলছিল কোচিং ক্লাস। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে ব্রিফিংয়ে একই তথ্য জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। জাহেদ কামাল জানান, ভবনটির প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসরুম। সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপালের অফিস ও মিটিং রুম। বিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয় তার আগেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়। তবে সেখানে চলছিল কোচিং ক্লাস। তিনি আরও জানান, ফায়ার সার্ভিস দুপুর ১টা ৮ মিনিটে খবর পায় এবং ১টা ২২ মিনিটে ঘটনাস্থলে প্রথম ইউনিট পৌঁছায়। মোট ৯টি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালায়। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও আশপাশের অনেক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহৃত হয়েছে। আহতদের ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে।