সূর্যোদয়ের আগে হাঁটাহাঁটি শরীরে মেদ জমতে দেয় না। ওভাবে হাঁটলে অস্থিসন্ধির জটিলতা দূর হয়, হজমশক্তি বাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। এই জ্ঞান আমায় দান করেছিলেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক রাহাত খান (জন্ম : ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪০-মৃত্যু : ২৮ আগস্ট ২০২০)। সকাল আট-নয়টার পর যাদের ঘুম ভাঙে, সেই দলের সক্রিয় সদস্য আমি। তাই রাহাত ভাইকে বললাম, সাত দিন টানা উপোস দিলেই তো মেদের জানাজা পাঠের মওকা এসে যায়। অন্নকষ্টে ভোগা মানুষ জীবনরক্ষার জটিলতায় অস্থির থাকে, অস্থিসন্ধি নিয়ে তার দুশ্চিন্তা করার ফুরসত কোথায়! হজমের সমস্যায় ভুগবার প্রশ্নই ওঠে না। ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যূনতম সুস্থতা ধরে রাখবার জন্য পেটে কিছু ধারণ করা। মন ফুরফুর করবে নাকি ঘুরঘুর করবে, সেটা অনেক পরের কথা।
‘তোমাকে নিয়ে এই-ই এক সমস্যা’ বলেন রাহাত খান, ‘যে কোনো বিষয়ে নেগেশন সিনড্রোমে সাফার কর। খালি নেতিবাচকটা তোমার নজরে পড়ে। ইটস আ ডিজিজ। মধ্যগগনে সূর্য উঠলে শয্যাত্যাগ করবে তো কর। কিন্তু ওটার পক্ষে সাফাই গেয়ে অন্যদেরও ওই বদভ্যাসে প্ররোচিত করতে চাইছ, ইটস অ্যান অ্যান্টি-সোশ্যাল অ্যাটিচিউড। এজন্য তোমারে দুগাজুমা করতে ইচ্ছে হয়।’
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দুগাজুমা? জবাবে রাহাত খান তাঁর বাঁ চোখ মেরে নিচুগলায় বলেন, মিনিংটা পাবলিকলি শুনতে চেয়ো না। তোমার প্রেস্টিজের ইয়ে হয়ে যাবে। হুমকি আর পরামর্শমিশ্রিত বাক্য শুনে চুপসে গেলাম। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দোতলায় অতিথি আপ্যায়নের কক্ষে দুই বন্ধুকে চা ও ডিমপুরি খাওয়াচ্ছিলেন রাহাত ভাই। আমি ওই কক্ষে আমার এক মেহমানের সেবা শেষ করলাম মাত্র। ‘আসো, আসো, অনেক দিন তোমায় দেখি না’ বলে তিনি তাঁর টেবিলে আমায় ডেকে নিয়েছিলেন। তাঁর বন্ধুদের সামনে ‘দুগাজুমা’ শব্দের অর্থ খোলাসা করলে আমার ইজ্জত সত্যিই কি জখম হবে?
এরকম ভাবছি আর ভাবছি। আবার একই সঙ্গে ভানও করছি যে তাঁদের তিন বন্ধুর আড্ডার মজাদার কথাবার্তা উপভোগ করছি। রাহাত খান হঠাৎ বললেন, তাঁর খুব জানতে ইচ্ছা করছে, কবে কোন বিষয়ে আমি তাঁর ইতিবাচক গুণ দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছি। তাঁকে জানাই যে তাঁর লেখা একটি গল্পের-‘রাবেয়া গোলাপের মতো সুন্দর, গোলাপের মতো একঘেঁয়ে।’ বাক্যটি আমার পরানের গভীরে গোলাপি আতরের সুবাস ছড়িয়েছে। এই উপলব্ধি বহু জায়গায় বহুজনকে জানিয়েই বসে থাকিনি; সাময়িকী ‘চিত্রবাংলা’র পাতায় সেটা ছাপার অক্ষরে বর্ণনাও করেছি।
‘মাই গড! কত বড় গলদা আমি।’ বলেন রাহাত খান, ‘বেহুদা তোমারে এত কাল ট্যারাচোখা মাথাগরম আদমি ভেবেছি। স্যরি, এক্সট্রেমলি স্যরি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুগাজুমা প্রত্যাহার করে নিলাম।’ তাঁর দুই বন্ধুর প্রশ্ন, দুগা দুগা করছ সমানে, মানেটা তো বলবে! রাহাত খান বলেন, অবশ্যই বলব। তবে এখন না। পাবলিকলি বলাটা ইনডিসেন্ট হবে।
২. ঠিকই বলেছেন রাহাত খান। পাঁচজনকে শুনিয়ে দুগাজুমার অর্থ বলে দিলে আমার এক্কেবারে চিৎপাত হয়ে যাওয়ার দশা হতো। একদিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি জানান, ‘দুই গালে জুতা মার’-এই শব্দ চতুষ্টয়ের আদ্য অক্ষরকে ক্রমানুসারে সাজালে যা পাবে সেটাই দুগাজুমা। তিনি বলেন, মনের ঝাল মেটানোর সুবিধার্থে সাংকেতিক ভাষার মতো উপাদেয় কি আর কিছু হয়? প্রকাশ্যে যাকে কুর্নিশ না করলে গর্দান ফাঁক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, মনে মনে তাকে শাপান্ত দিয়ে যারা অতৃপ্ত, তারা নিজেরা সবার সামনে নির্বিঘ্ন উচ্চারণের লক্ষ্যে একটা সংকেত তৈরি করে নেয়। উচ্চারণজনিত একটা আমোদও তখন পাওয়া যায়।
সাংকেতিক সেই ভাষা প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার হয়ে ওঠে কখনো কখনো। কখনো কখনো হয়ে ওঠে হুঁশিয়ারি। ‘সংবাদ’ সম্পাদক বজলুর রহমান (জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৪১-মৃত্যু : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)। যখন রুষ্ট মেজাজে থাকতেন তখন আমরা তাঁর অধীন সাংবাদিকরা তাঁর জেরার মুখোমুখি হতে ভয় পেতাম। কোন প্রশ্নের জবাবে বানিয়ে বানিয়ে কী বলতে হবে, তা ঠিক করার জন্য আগে মতবিনিময় করে নিতে হতো। তবু কোন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তিনি বুঝে ফেলতেন। অধীনস্থদের কারও অন্যায় আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে গর্জন করেছেন বা গর্জন করে যাচ্ছেন, এ অবস্থায় তাঁর সামনে পড়লে, সামনে পড়াকে কোন্ ভুল বা অন্যায়ের জন্য বাক্যবাণে জর্জরিত করা হবে কে জানে! সেজন্য ‘বড় হুজুর গরম হয়ে আছেন’ মর্মে হুঁশিয়ারি দেওয়ার সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করতাম আমরা। বলতাম-‘কুহরিছে নন্দনের পাখি’।
ওই পত্রিকায় আমার সহকর্মী মজিদুল হক একদিন জানান, তিনি যে ফ্ল্যাটে বাস করেন তার উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের ভাড়াটে বরেণ কুশারীর জীবন কয়লা করে ফেলছে নন্দনের পাখি। আমরা চমকে উঠলাম। বজলু ভাই এখানে কেন? মজিদ বলেন, এই পাখি সেই পাখি না। কুশারী সদাগরি অফিসের নির্বাহী পদে চাকরি করেন। নিয়মিত বেতন পান না। নিয়মিত তাগাদা দেন বাড়িঅলা-‘বকেয়া ভাড়া এখনই চাই’। কোনো অজুহাতই তিনি মানেন না। দিতে হবে দাও/এখনই দাও। প্রায় প্রতি সপ্তাহে উৎপাত। অগত্যা সিদ্ধান্ত হয়, বাড়িঅলাকে এড়িয়ে চলাই ভালো। বাড়ির উল্টো দিকের দোকানের সেলসম্যানের সঙ্গে বন্দোবস্ত হলো : বাড়িঅলা আসছে দেখলে সে গাইতে থাকবে-‘মধুর মধুর বংশী বাজে/কোথায় কোন কদমতলীতে...।’ সংকেত পেয়ে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে চম্পট হবেন বরেণ কুশারী। বাড়িঅলাও কম যান না। একদিন তিনি দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে বলেন, আমারে দেখলেই তুমি বংশী বাজাও, অন্য সময় তোমার গলা দিয়া হুক্কাহুয়া আওয়াজও বারয় না, কেস্ কী য়্যাঁ? বংশী বাজাইয়া কুশারী সাবরে সিগন্যাল পাঠাও না তো? সেলসম্যান বলে, কী যে কন না চাচা! অল্প বেতনের চারকি করি বইলা কি মনের সুখের জন্য একটু গানও গাইবার পারুম না?
৩. ‘অল্প বেতনের চাকরি’ কথাটা ‘শতাধিক টাকা’র মতোই প্যাঁচালো। আমার দৃষ্টিতে বেতন দশ লাখ মানে বিস্তর টাকা। ইলন মাস্কের কাছে এই টাকা হাফ কেজি তেজপাতার সমানও নয়। আবার দেখতে পাই, এক শ এক মানে শতাধিক টাকা। দশ কোটিও কিন্তু শতাধিক টাকা। এই বিবেচনা থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে বেতনের শতাধিক টাকায় পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর আবদুস সালামের জীবন চলছিল না। তাই তিনি পাঁচজন ভাঙারির কাছ থেকে ১৭ জুন ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।
ভাঙারিরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনাবেচা করেন। ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার বাসিন্দা তাঁরা। নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের পুলিশ ক্যাম্পের এসআই আবদুস সালাম তাঁদের ধরে এনে বলেন, ৮০ হাজার টাকা ঘুষ না দিলে মামলার আসামি বানিয়ে কোর্টে চালান করে দেব। হুমকিতে ‘কাজ’ হয়ে গেছে। বিষয়টি পুলিশের উচ্চ মহলের কানে গেলে সালাম টের পান-‘বিপদ আসন্ন’। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, ঘুষ ফেরত দেওয়ার জন্য আবদুস সালাম ছোটাছুটি করছেন কিন্তু ভুক্তভোগীদের মন গলছে না। তাঁরা নাকি নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁদের অপেক্ষা সার্থক হবে? যদি না হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে যে ঘুষ নেওয়ার মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে দারোগা সালামের মানহানির দায়ে পাঁচ ভাঙারির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে।
পাকিস্তানি জমানায় আমাদের জেলা শহরে আমজাদ আলী নামে কড়া মেজাজি এক দারোগা ছিলেন। রাতে বাতিহীন রিকশা আটক করে তিনি কনস্টেবলদের বলতেন, ‘দশ ট্যাবলেট লওন ছাড়া এইয়ারে ছাড়বেন না কইলাম।’ ট্যাবলেট মানে টাকা। শহরের মধুসূদনপুরের হাবিব একদিন বলে, টাকারে টাকা না কইয়া ট্যাবলেট কন কিয়েল্লাই? আমজাদ আলী বলেন, কলেজ স্টুডেন্ট তুমি, আরামে হারাম খাওনের কাম ইশারায় সারা লাগে এইডাও বোঝো না?
৪. হারাম খাওনের কাজ ছাড়াও কিন্তু ইশারার ব্যবহার চলে। এ বিষয়ে তিনটি ঘটনা বলতে পারি।
এক. সাড়ে চার বয়সি ছেলেকে মা ভদ্রতা শেখাচ্ছেন। বাইরের লোকজনের সামনে ‘মা পেসাব করব, বাথরুমে নিয়ে চল’ এরকম কখনো বলবে না। বলবে, ‘গান গাইব মা, গাইতে নিয়ে চল।’ কদিন পর এই ছেলে তার বাবা-মার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়। মায়ের কোলে বসা খোকন বিরতির কিছুক্ষণ আগে বলতে থাকে, ‘মা গান গাইব। গাইতে নিয়ে চল।’ ‘মা বলেন, ঠিক আছে। একটু পরে গাইয়ো।’ ছেলেটি মানে না, ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই থাকে। দর্শকদের একজন বলে, ‘বাহ! এইটুকুন খোকা গান গাইতে চায়। দিন না আপা, ছেলেকে গাইতে দিন।’ খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘গান গাই মা? তোমার কোলে গা-ই-ই-ই।’ এ সময় আরেক দর্শক বলেন, ‘গাইতে চাচ্ছে খোকন সোনাকে গাইতে দিন ভাবি। আমরা ডিস্টার্ব ফিল করব না।’ মা বললেন, গাইতে দেওয়ার উপায় আর নেইরে ভাই। অলরেডি সে গেয়েই ফেলেছে।
দুই. নবম শ্রেণির ছাত্রদের শিক্ষক বললেন, তোমরা সব সময় শোভন আচরণ করবে। অনেক শব্দ বা কথা আছে যেগুলোর সরাসরি উচ্চারণ উচিত নয়। সেদিন কুতুবউদ্দিন ভরা ক্লাসে বলে বসে, ‘পায়খানা পাচ্ছে, যাব?’ কথাটা ইশারায় বললেই সুন্দর হতো। বলতে পারত, ‘বড়ঘরে যেতে হবে, যাই?’ রাইসুল হকও নির্লজ্জ ছেলে। বলে কি না, ‘স্যার পেসাবের বেগ পাচ্ছে, যাই?’ শিক্ষক বলেন, ওর বলা উচিত ছিল ‘বাইরে যাওয়া দরকার।’ আমি হয়তো বলতাম, ‘কেন?’ তখন তার বলা উচিত, ‘চাপ আছে, তাই।’
সপ্তাহখানেক পরে ক্লাস চলছে। শিক্ষক পাঠদান করছেন, যেনতেন প্রকারে লক্ষ্যে পৌঁছানোকে সাফল্য বলে মেনে নেওয়া বিরাট ভুল। সফলতার চূড়ায় কীভাবে ওঠা হলো, সেটা বুঝতে হবে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে লাভজনক কিছু অর্জন করা আর তস্করবৃত্তি অবলম্বন একই কথা। এ ধরনের ওপরে ওঠা কার্যত নিচে নেমে যাওয়া, অধঃপতনের প্রক্রিয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা...।ঠিক এ সময় কুতুবউদ্দিন দাঁড়িয়ে বলে, ‘স্যার! একটু বাইরে যাওয়া দরকার।’ শিক্ষক বলে, ‘কেন। চাপ আছে?’ ছাত্র বলল, ‘না স্যার। চাপের বাপ আছে।’ অর্থাৎ মলত্যাগে বিলম্ব আর সইছে না।
তিন. সর্বদা খোশমেজাজি কিশোর কুমার তাঁর পেশার ব্যাপারে পরম নিষ্ঠাবান ছিলেন। পারিশ্রমিক কড়ায়গন্ডায় বুঝে নেওয়ার আগে গাইতেন না। পাওনা আদায়ের বেলায় তাঁর ব্যবহৃত সাংকেতিক ভাষাও মজাদার। বলতেন, ‘আরে ভাই, এখনো চা খাওয়ালে না।’ কথাটার অনুবাদ হলো, চেক তো এখনো দিলে না। লেনদেনের কাজটা করতেন কিশোর কুমারের ব্যক্তিগত সচিব আবদুল মোনায়েম। সচিব ইশারা করলে তিনি প্লেব্যাক গানে কণ্ঠদান করতেন বা মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করতেন। এ সম্পর্কে কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমার স্মৃতিচারণ করেন, ‘যোশিলা’ (মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে) ছবির জন্য গান রেকর্ডিংয়ে এসেছেন বাবা। সংগীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মণ বারবার তাগাদা দিচ্ছেন, ‘দাদা জলদি করুন’।
‘চা’ না খাওয়ায় কিশোর সাড়া দেন না। ছবির পরিচালক যশ চোপরা বলেন, ‘মিস্টার গাঙ্গুলী হারি-আপ প্লিজ’। তখন কিশোর কুমার ওই ছবিরই গান ‘কিস্কা রাস্তা দেখে’র সুর অনুকরণে গেয়ে ওঠেন- ‘আবদুল, আবদুল, পয়সা মিলা কেয়া/জলদি সে বাতা দে।’ অদূরে দাঁড়ানো আবদুল মোনায়েম মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সংকেত দিলেন, হ্যাঁ, চেক পেয়ে গেছি।
লেখক : সাংবাদিক