নির্বাচনের আগে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে অপরাধজগৎ। তৎপর হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্র্ল্ডের ভয়ংকর সন্ত্রাসী এবং তাদের সহযোগীরা। সীমান্ত পেরিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্রে সারা দেশে বেড়েছে রক্তের খেলা। এক বছরেও হদিস নেই পুলিশের লুট হওয়া ১ হাজার ৪০৫টি অস্ত্র ও আড়াই লাখ গুলির। বৈধ লাইসেন্সধারীদের জমা না দেওয়া ১ হাজার ৬৫৪টি অস্ত্রও এখন অবৈধ হয়ে অপরাধীদের হাতে।
রাজধানীর মহাখালীতে ১ আগস্ট রাতে গুলি করে জামাল হোসেন নামে এক যুবককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন দারুস সালামে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করা হয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ী তাহমিনা রহমানকে। এ দুই হত্যায় জড়িতরা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগী- এমনটিই বলছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এলিট ফোর্স র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রয়োজনীয় সব কিছুই করছে র্যাব। অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবেই দেখি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সব প্রস্তুতিই আছে। এখনো নির্দেশনা পাইনি। অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন- থানা থেকে লুট হওয়া বেশির ভাগ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এসব ব্যবহৃত হচ্ছে হত্যা, হামলা, ছিনতাই, ভাঙচুর ও চাঁদাবাজির ঘটনায়। সীমান্ত পেরিয়ে আসছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং পতিত হাসিনা সরকারের মদতপুষ্ট অপরাধীদের কাছে যাচ্ছে এসব অস্ত্র। একটি বিদেশি শক্তিও তাদের সহায়তা করছে। গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর ৪৬০ থানা ও ১১৪ ফাঁড়ির পিস্তল, রাইফেল, এসএমজি, শটগানসহ ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি গুলি লুট হয়। গণভবন থেকে লুট হয় এসএসএফের ৩২টি ভারী অস্ত্র। লুট হয় কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, শেল, স্প্রে, বিভিন্ন বোরের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড। র্যাব সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে র্যাবের লুট হওয়া ৯০, পুলিশের ২২৮ এবং ১৬৬টি অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ২০ হাজারের বেশি গুলি। থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের বড় অংশ এখনো অপরাধীদের হাতে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ত্রধারীরা অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। লঙ্ঘন করছে মানবাধিকার। নির্বাচনের আগে সহিংসতা ঠেকাতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন জানান, অনেক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, বাকিগুলো উদ্ধারে অভিযান চলছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দল এবং ব্যক্তি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে অপরাধ দমন করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন কোনো কিছুই গোপন থাকে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ৫১ হাজার ৭৫৮টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দেওয়া হয় ১০ হাজার ৮৪৫টির। এগুলোর লাইসেন্স স্থগিত করে জমা চায় সরকার। জমা পড়ে ৯ হাজার ১৯১টি অস্ত্র। জমা না পড়া ১ হাজার ৬৫৪টি অস্ত্র এখন অবৈধ।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় ভারী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা। শটগান হাতে থাকা সন্ত্রাসী সাজ্জাত হোসেনের নাম জানতে পারে পুলিশ। ২১ জুন নরসিংদীর পলাশে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদল কর্মী ইসমাইল হোসেনের মৃত্যু হয়। ১৫ জুন ঘোড়াশালে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন ১০ জন। ২০ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় শিবুউ মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৩ আগস্ট কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে সাবেক ইউপি মেম্বার আলাউদ্দিনকে বাড়ির সামনে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে প্রেমিকের হাতে খুন হন শাহিদা ইসলাম নামে এক নারী। ১৯ জুন রাজধানীর পল্টনে মাদক কারবারিদের ছোড়া গুলিতে পুলিশের দুই সদস্য আহত হন। ১৮ জুন রাজধানীর মিরপুরে গুলি করে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর ২১ লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এর আগে ৬ আগস্ট মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামের এক যুবক। গুলিবিদ্ধ হন শুভ নামের আরেক যুবক। ১৭ আগস্ট আবারও সংঘর্ষ হয়। চলে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত। ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবার সংঘর্ষ হয়। ৪ সেপ্টেম্বর গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলি। এর মধ্যে চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম এবং ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হন। ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোরে মারা যান। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন। ৩১ মে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলিতে মারা যায় রাসেল নামের এক শিশু।