ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশের রুট ব্যবহার করেই দেশে প্রবেশ করছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। পরে তা অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং সন্ত্রাসীদের হাত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিশ্লেষকরা বলছেন- আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক খুনের ঘটনায় বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হলে দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়বে বহুগুণ। বিজিবি রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ যাবতীয় চোরাচালান রোধে কাজ করছে বিজিবি। চলতি বছর অনেকগুলো অভিযান চালানো হয়। অভিযানগুলোতে প্রচুর অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। দেশকে নিরাপদ রাখতে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তের ওপার থেকে অবৈধভাবে আসা এসব অস্ত্র নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে। সাধারণত নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে সব সময় শঙ্কা থাকে। তাই অবৈধ অস্ত্র আসা রোধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর হওয়া প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার। তার মতে, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের ত্রিদেশি দুর্গম সীমান্ত এলাকা ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলে অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী সক্রিয়। তাদের আয় বলতে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা। কুখ্যাত ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল থেকে দেশে অস্ত্র আসার কথা শুনছি। মূলত মাদক পাচারের রুট ব্যবহার করেই বাংলাদেশে আসছে এসব অস্ত্র। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য মতে- বাংলাদেশে স্থল ও নৌপথের ৩০টি রুট দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র প্রবেশ করে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। মূলত অস্ত্রগুলো মিয়ানমার থেকে এ পথে আসে। এ ছাড়া, উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও হিলি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র চোরাচালানের তথ্য পাওয়া যায়। দক্ষিণ বঙ্গের সাতক্ষীরা ও যশোর সীমান্ত দিয়েও অস্ত্র ঢোকে বাংলাদেশে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় দুর্গম বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’। ভারতের মিজোরাম রাজ্য, বাংলাদেশের বান্দরবান ও রাঙামাটি এবং মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য মিলে তৈরি হয়েছে অপরাধের অন্ধকার এ জগৎ। এ এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা মিয়ানমার কোনো দেশেরই নিয়ন্ত্রণে নেই। এ সুযোগে দুর্গম এ পাহাড়ি অঞ্চলটিতে সক্রিয় রয়েছে ছোট বড় শতাধিক মিলিশিয়া গ্রুপ। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের মিয়ানমার অংশে কাচিন এবং সান স্টেটে ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’ নামে একটা জোট রয়েছে। এ জোটের অপর নাম হচ্ছে ‘ব্রাদারহুড’। এ জোটের সদস্য হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ), তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাট অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)। তাদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে রয়েছে কাচিন ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএলও), ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট, কাচিন ইন্ডিপেন্ডন্স আর্মি (কেআইএ) এবং ইউনাইটেড ওয়াহ স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ)সহ শতাধিক মিলিশিয়া বাহিনী। এ অঞ্চলের সক্রিয় মিলিশিয়া বাহিনীর আয়ের কোনো উৎস না থাকায় অস্ত্র ও মাদক উৎপাদন এবং পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। তাদের সাংগঠনিক ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসে অস্ত্র ও মাদক সংশ্লিষ্ট খাত থেকে। এ মিলিশিয়া বাহিনীগুলো কক্সবাজার, বান্দরবান এবং রাঙামাটির সীমান্তঘেঁষা এলাকাগুলোকে মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র প্রবেশের নিরাপদ রুটে পরিণত করেছে। মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর সহযোগিতায় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে নানা কৌশলে অবৈধ অস্ত্র ঢোকে বাংলাদেশে। তারপরে, নানা সিন্ডিকেটে হাত বদলে চলে যায়, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের কাছে। এরই মধ্যে সীমান্তে তৎপরতা বৃদ্ধির দাবি করেছে বিজিবি। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে সীমান্ত এলাকায় মাদক ও অন্যান্য চোরাচালান রোধে বিজিবির সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ। সব ধরনের চোরাচালান রোধ আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’ দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ বৃদ্ধির কারণ নিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর রাজ্যে অস্থিরতা চলছে। একইভাবে দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসংলগ্ন সীমান্ত এলাকা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে সংঘাত চলছে। এ অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র কারবারিরা।