জাতীয় বাজেট বরাদ্দের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নয়নে কৃষি খাতের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ২ শতাংশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ কর্মজীবী নারীর প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির অবদান প্রায় ৭ শতাংশ। কৃষি খাতের অগ্রগতির ওপর শিল্প ও সেবা খাতের অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসারে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ৪ থেকে ৫ শতাংশ হওয়া দরকার। এক যুগ ধরে জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল বাজেটের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ৪ দশমিক ৮৭ গুণ বেশি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। ঘোষিত বাজেটটি বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য। নতুন বাজেট গত বছরের চেয়ে কম হলেও জনগণের খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। নতুন বাজেটে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্যনিরাপত্তা খাতে মোট ৩৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। গত বছর আকস্মিক বন্যায় আউশ ও আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুতে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আমরা ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ৭ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিই, যার আওতায় ইতোমধ্যে ৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ২ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সারসহ অন্যান্য উপকরণে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিচ্ছি। এ ছাড়া খাদ্যনিরাপত্তার গুরুত্ব বিবেচনায় সারের মজুত বা বাফার স্টক বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে শস্যকৃষি খাতে ২৭ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অবশিষ্ট ২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি খাতে ন্যূনপক্ষে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ অর্থ নিয়োজিত করা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। নতুন বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। কৃষি খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষি ভর্তুকি মোট বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ হওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে। কৃষি খাতে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বেশ যৌক্তিক। কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি শুল্ক সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানিতেও বিদ্যমান শুল্কহার হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো কৃষি উন্নয়নে বেশ সহায়ক হবে। বাজেটে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ খাতে মোট বরাদ্দ ৮ হাজার ৩২২ কোটি টাকা, বেড়েছে ১ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা খুবই কম, মাত্র ২১ দশমিক ৮৬ মেট্রিক টন। নতুন অর্থবছরে তা ৩৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে খাদ্যশস্য ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে। দেশে ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের ধারণক্ষমতা বাড়ানো গেলে আপৎকালীন প্রয়োজন মেটানো সহজ হবে। দেশের বেশির ভাগ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণকরত বাজেটে সম্পূরক বরাদ্দ বাড়ানো গেলে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেত। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রণোদনা ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির জন্য বাজার অবকাঠামো আধুনিকায়ন, মূল্য কমিশন গঠন ও নির্বাচিত পণ্যের মূল্য সহায়তা প্রদান সময়ের দাবি। দুর্যোগ মোকাবিলায় শস্যবিমা চালুকরণ এবং বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও খেতমজুরদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ উপকারে আসবে। দেশ এখন ভ্যালু অ্যাডেড এগ্রিকালচারের দিকে ধাবমান। তাই কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের প্রসার ঘটাতে এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ বা বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে। মৌসুমি ফল, আলু, শাকসবজি ও পিঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বা বরাদ্দ বাড়ানো গেলে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট