দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা, ব্যাংকঋণ পেতে সমস্যা, অবকাঠামোগত সংকট, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। এসব সমস্যা দূর করে টেকসই বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। তারা জাতীয় স্বার্থ অগ্রাহ্য করে যেন কোনও বিদেশি বিনিয়োগ না নেওয়া হয় সেই আহ্বান জানান। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ ও সুপারিশ গ্রহণের লক্ষ্যে এ সভার আয়োজন করে বিডা।
মঙ্গলবার (১৩ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংস্থাটির কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন (আশিক চৌধুরী)। সভায় দেশের ১৯টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে ১৭টি দল থেকে কোনও শীর্ষ নেতা বা প্রতিনিধি অংশ নেন। তবে বড় দুইটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) কেউ সভায় অংশ নেননি।
বিএনপি ও বিজেপি ছাড়া বিডার মতবিনিময়ে আমন্ত্রণ পাওয়া অন্য দলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ।
সভায় সূচনা বক্তব্যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। এটি দলীয় বা রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে।’ বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিডা কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানামুখী সংকট রয়েছে। এসব সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য আমরা এখন কী করছি, সামনের ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে কী করব এসব বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে বলে প্রত্যাশা করি।’
আশিক চৌধুরী আরও বলেন, আমরা জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি মাথায় রেখেই বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলছি।’
সভার শুরুতে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের কিছু চিত্র তুলে ধরেন বিডার ব্যবসা উন্নয়ন প্রধান নাহিয়ান রহমান। তিনি জানান, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সংস্কার ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় এফডিআই কৌশলপত্র প্রণয়ন ও পাইপলাইন তৈরি, সব ধরনের কাস্টমস–প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা, ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া, অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) চালু প্রভৃতি উদ্যোগ।
কোন দল কী বলেছে
সভায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদহার অনেক বেশি। করপোরেট করহার বেশি। দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি কমেনি। এগুলো ব্যবসার ব্যয় বাড়াচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে জায়গায় জায়গায় আইনের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হয়। এমন পরিবেশ থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। এ জন্য সবার আগে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ব্যবসার উদ্যোগ বা বৃহৎ বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশগত বিষয়, যুব কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরে জোর দেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, বিনিয়োগ উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে যুব কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।
জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ আনার পরামর্শ দিয়েছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আকাশ বলেন, জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে যেন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ না হয়। তিনি বলেন, অতীতে এমন কিছু বিনিয়োগ এসেছে, যেগুলো এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। এসব বিষফোড়া থেকে রাষ্ট্র নড়তেও পারছে না, সরতেও পারছে না, ধরতেও পারছে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রতিযোগী সক্ষম করতে জ্বালানি সমস্যা দূর করা, বন্দরসুবিধা বৃদ্ধি ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তো আগের মতোই আছে। ফলে বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে। বিনিয়োগ কম হওয়ার পেছনে এখনো হয়রানি একটি বড় কারণ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব সৈয়দ এছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের বলেন, দেশে এখন প্রধান সমস্যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। স্থানীয় পর্যায়েও একটা ব্যবসা শুরু করতে হলে ১৮টি জায়গা থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। আর প্রতিটি জায়গায় টাকার বান্ডেল দিতে হয়। দেশের সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ইকোনমিক চার্টার তৈরির পরামর্শ দেন এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসরিন সুলতানা।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ