দেশের শিল্পায়ন ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে এখনই টেকসই ও বিনিয়োগ উপযোগী জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বাড়লেও নীতিগত অস্থিরতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ ঝুঁকি জ্বালানি খাতকে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে জ্বালানির সংকটের সমাধান করা। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ আয়োজিত নীতিসংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আওয়াল মিন্টু, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শুরা সদস্য মোবারক হোসেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন প্রমুখ। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ব্যবসায়ী নেতা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকার ও বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা।
জালাল আহমেদ বলেন, দেশ এখনো ১৯৯৬ সালের প্রাচীন জ্বালানি নীতির ওপর নির্ভর করছে। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো বহু আগেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির আধুনিক কৌশল গ্রহণ করেছে। অতি আশাবাদী পরিকল্পনার ফলে উৎপাদনক্ষমতা বাড়লেও সঞ্চালন ও বিতরণে বিনিয়োগ না থাকায় সার্বিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সিঙ্গেল বায়ার মডেলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ক্রেতা যদি আর্থিকভাবে অক্ষম হয়, পুরো পাওয়ার সাপ্লাই চেইনই ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪ হাজার কারখানায় ৫১০ মেগাওয়াট করে রুফটপ সোলার স্থাপন করতে পারলে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে। এটি অধিক নিরাপদ, ব্যয় সাশ্রয়ী, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। আমাদেরকেও টেসকই উন্নয়নের জন্য সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশে সম্পদ সৃষ্টি হয় কিন্তু তা সবসময় ব্যবসায়িক সাফল্যে রূপ নেয় না। শক্তিশালী অর্থনীতি রাজনীতিকেও শক্তিশালী করে। তাই বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গত তিন বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০%, যা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। তিনি সৌর, বায়ু, বর্জ্যভিত্তিক জ্বালানি, সীমিত পরমাণু ও কয়লা সমন্বয়ে বৈচিত্র্যময় জ্বালানি মিশ্রণের ওপর জোর দেন। ভবিষ্যৎ নীতি হতে হবে বেসরকারি খাত নেতৃত্বাধীন, বিনিয়োগবান্ধব ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জ্বালানি সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন। জ্বালানি, গ্যাস ও পানির সংকট দীর্ঘদিনের হলেও অতীতে বিপুল বিনিয়োগ সমস্যার সমাধানে তেমন ভূমিকা রাখেনি। তিনি দুর্নীতি ও দায়হীনতার সংস্কৃতিকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেন।
জামায়াতে ইসলামীর শুরা সদস্য মোবারক হোসেন বলেন, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের নামে বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করেছে। জামায়াত ক্ষমতায় এলে বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগিয়ে খাতটির সার্বিক উন্নয়ন করবে। সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, আইইউবির ভাইস চ্যান্সেলর ম. তামিম বলেন, শক্তি খাতে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির অভাব সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি সতর্ক করে বলেন, ২০২৯ সাল পর্যন্ত দেশ জ্বালানি ঘাটতির ঝুঁকিতে থাকতে পারে। পরবর্তী সরকারে যারা আসবে তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে জ্বালানি সংকটের সমাধান করা।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, বিদ্যুতের দাম শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সরবরাহ করা বিদ্যুতের হার অত্যধিক উল্লেখ করে তিনি পাঁচ বছরের জন্য স্থিতিশীল ট্যারিফ নির্ধারণের দাবি জানান।
এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি বিশেষত সৌরবিদ্যুৎ থেকে অন্তত ৪ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ভূমির অভাব বড় বাধা বলে মনে করেন তিনি।
বিদেশে অবস্থান করায় অনলাইনে যুক্ত ছিলেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। আরও বক্তব্য দেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এমডি ও চিফ রিস্ক অফিসার এনামুল হক, বিডার ডিজি মো. আরিফুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আহমেদ জুবায়ের মাহমুদ এবং কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইমরান করিম। ইএমএ পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেডের পরিচালক আবু চৌধুরী।