বাবার মৃত্যুর এক মাস পরই এসএসসি পরীক্ষায় বসতে হয়েছে সুমাইয়াকে। কল্পনাও করা যায় না এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল সুমাইয়া আফরিন। দিনমজুর বাবা দীর্ঘদিন প্যারালাইসিসে ভুগেছেন। চিকিৎসার খরচে পরিবার হারিয়েছে সবকিছু। শেষ পর্যন্ত গত ১২ মার্চ সুমাইয়ার বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তখনই যেন আলোহীন গহিন অরণ্যে হারিয়ে গিয়েছিল সুমাইয়ার ছোট্ট পৃথিবী। চোখের পানি শুকিয়েছে কান্নায়। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি তার গল্প। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া সুমাইয়ার জীবন বদলে দিতে পাশে এসে দাঁড়ায় বসুন্ধরা শুভসংঘ। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ আর একটি সেলাই মেশিন পেয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছে এই মেধাবী কিশোরী। বেতাগী উপজেলার পুটিয়াখালী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া সুমাইয়া বলে, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর যখন অসহায় হয়ে কাঁদছিলাম, ঠিক তখনই বসুন্ধরা শুভসংঘ আমাকে সেলাই প্রশিক্ষণে যুক্ত করে। আমি অনেক কষ্টে, ভাত না খেয়েও পরীক্ষা দিয়েছি। সেলাইয়ের কাজ শিখে আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এই মেশিন দিয়ে আমি আয় করতে পারব, মাকে খাওয়াতে পারব, ছোট ভাইকে পড়াতে পারব। আমি নিজেও কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারব।’ সুমাইয়ার মতো ক্ষুদ্র আয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা বনানী বিশ্বাস। বাবার সঙ্গে কখনো মাঠে কৃষিকাজ, আবার কখনো বাঁশ-বেতের কাজে সহযোগিতা করা তার নিত্যদিনের বাস্তবতা। তবু চোখে ছিল স্বপ্ন। নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া এবং স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারকে সাহায্য করা। বসুন্ধরা শুভসংঘের সহায়তায় সেই স্বপ্ন এখন ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ নিচ্ছে তার। বাবা বাবুল বিশ্বাস দিনমজুর। বেতাগী উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের এই মানুষটি কখনো মাঠে কৃষিকাজ করেন, কখনো বাঁশ-বেত দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন। তার উপার্জনেই চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। মা কানন বিশ্বাস গৃহিণী। পরিবারের আয় এমনিতেই সীমিত, তার ওপর মেয়ের কলেজের খরচ চালানো যেন এক যুদ্ধের বিশাল প্রস্তুতি। এসব প্রতিকূলতার মাঝেও এ বছর বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে বনানী বিশ্বাস। তার প্রতিদিনের রুটিনে ছিল ক্লাসের পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করা। কাদা মাখা পায়ে, রোদে পুড়ে, ধুলায় ভরা দিনে সে জানত, একমাত্র শিক্ষাই পারে তার জীবনের দিক পরিবর্তন করতে। বসুন্ধরা শুভসংঘ আয়োজিত তিন মাসব্যাপী সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নেয় বনানী। প্রশিক্ষণ শেষে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি সেলাই মেশিনও পেয়েছে। বনানী জানায়, ‘বাবার সামান্য আয়ে পরিবার চালানোই কঠিন। আমার পড়ালেখার খরচ জোগানো অনেক কষ্টের। এখন আমি সেলাই কাজ শিখেছি, নিজের আয় দিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। বসুন্ধরা শুভসংঘ আমার ভবিষ্যতের স্বপ্নের ঠিকানা দেখিয়ে দিয়েছে।’
উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী উপজেলায় বসুন্ধরা শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিন মাস বিনামূল্যে সেলাই ও কাপড় কাটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দরিদ্র পরিবারের ১৫ অসচ্ছল নারী। প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সামনে খুলে যায় এক বিশাল সম্ভাবনার দরজা। সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে উপহার দেওয়া হয় একটি করে সেলাই মেশিন। এই উপহারে আনন্দে উচ্ছ্বসিত সবাই। প্রতিটি মুখেই হাসি, চোখে ভবিষ্যতের নতুন স্বপ্ন। তাদের জীবনে যেন বইতে শুরু করেছে সুখের এক নির্মল বাতাস। এই ১৫টি পরিবারের সুখের আলো পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। এটি বসুন্ধরা গ্রুপের একটি মানবিক উদ্যোগ। যেখান থেকে জন্ম নেয় স্বপ্ন, সাহস আর সম্ভাবনার গল্প।
কালের কণ্ঠের বেতাগী উপজেলা প্রতিনিধি স্বপন কুমার ঢালীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান। এখন পর্যন্ত সারা দেশে দুই হাজারের বেশি নারীকে স্বাবলম্বী করতে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি উপকারভোগীদের অনুরোধ করেন, তাঁরা যেন সেলাই মেশিনটি যথাযথভাবে কাজে লাগান এবং নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলেন। বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশির গাজী বলেন, ‘দেশে সামাজিক ও মানবিক কাজের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অসহায়, বিধবা, এতিম, দরিদ্র অসচ্ছল নারীদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেকের হাতে বিনামূল্যে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হচ্ছে। এমন মহতী কাজের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ আয়োজকরা জানান, এই ১৫টি পরিবার এখন আত্মবিশ্বাসী হবে। তারা শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে না বরং পরিবারের দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাবে। সমাজের এই সাহসী মেয়েদের মতো অনেকেই যদি সুযোগ পায়, তাহলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কেউ পিছিয়ে থাকবে না। বসুন্ধরার সহায়তায় শুভসংঘের এই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া, বদলে দিচ্ছে হাজারো জীবনের গল্প।