পোপের দায়িত্ব কী?
‘পোপ’ মূলত খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ক্যাথলিক চার্চের একজন সর্বোচ্চ নেতা এবং সেন্ট পিটারের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত। এ পদের মাধ্যমে তিনি কয়েক শ কোটি অনুসারীর প্রধান ধর্মযাজকে উপনীত হন। ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এ উত্তরসূরিত্ব তাঁকে সরাসরি যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ফলে তিনি বিশ্বাসীদের জন্য আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। বাইবেলের পাশাপাশি পোপের শিক্ষা এবং বক্তব্য চার্চের বিশ্বাস ও আচরণ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে অন্যান্য খ্রিস্টান গোষ্ঠী যেমন- প্রোটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্সরা পোপের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না।
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনাবসান
জর্জ মারিও বেরগোগলিও, যিনি পোপ ফ্রান্সিস নামে পরিচিত, ক্যাথলিক চার্চের ২৬৬তম পোপ। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ইতিহাস গড়েন। তাঁর সরল জীবনযাপন, দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি এবং চার্চের সংস্কারের প্রচেষ্টা তাঁকে অনন্য করে তুলেছে...
২১ এপ্রিল পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দিনটি ছিল- খ্রিস্টধর্মীয় ইস্টার সানডের পরের দিন। মৃত্যুর একদিন আগে, পোপ ফ্রান্সিস সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে হাজির হয়ে হাজার হাজার ক্যাথলিক সমর্থকদের মাঝে ইস্টার সানডের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ভ্যাটিক্যান সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পোপ ফ্রান্সিস স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৩ সালে তিনি ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এর বর্ষসেরা ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিনয়, নম্রতা এবং শান্তির আহ্বানের জন্য ব্যাপকভাবে সুপরিচিত ছিলেন- বিশেষত কভিড-১৯ মহামারি এবং গাজায় মানবিক সংকট।
তাঁর আসল নাম জর্জ মারিও বেরগোগলিও। ২০১৩ সালে তিনি খ্রিস্টধর্মীয় ক্যাথলিক গির্জার ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত হন। তাঁর পূর্বসূরি পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ প্রায় ৬০০ বছরের মধ্যে প্রথম পোপ হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস ইতিহাসে প্রথম কোনো ল্যাতিন আমেরিকান ছিলেন, যিনি খ্রিস্টধর্মীয় সর্বোচ্চ নেতা (পোপ)। সাদামাটা চরিত্রে ফ্রান্সিস ছিলেন- প্রথম জেসুইট পোপ এবং প্রায় ১,২৮২ বছর পর প্রথম নিযুক্ত অ-ইউরোপীয় পোপ। ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে জন্ম নেওয়া ফ্রান্সিস সাদামাটা জীবনধারা, দারিদ্র্যপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি, আন্তঃধর্ম সংলাপ এবং পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার থাকার জন্য বিশ্বজুড়ে অনন্য এক পরিচিতি লাভ করেন।
ইতিহাস গড়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস
পোপ ফ্রান্সিসের অভিষেকের মাধ্যমে বিশ্ববাসী অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথম পোপ, যিনি ল্যাতিন আমেরিকা থেকে এসেছিলেন। ৭৪১ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী গ্রেগোরি তৃতীয়-এর মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত কোনো পোপ ইউরোপের বাইরে থেকে আসেননি। তিনি ছিলেন একজন জেসুইট (খ্রিস্টের সৈনিক, পোপ পদীয় সৈনিক)। তাঁর পূর্বসূরি, বেনেডিক্ট ষোড়শ ছিলেন প্রথম কোনো পোপ যিনি প্রায় ৬০০ বছর পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রায় ১০ বছর ধরে দুই পোপ ভ্যাটিক্যানে বসবাস করেছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস নিজেকে আপসহীন হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। আশা করা হচ্ছিল, তাঁর অ-প্রথাগত ব্যাকগ্রাউন্ড ভ্যাটিক্যানকে নবজীবিত করবে এবং পবিত্র মিশনগুলোকে শক্তিশালী করবে। অনেক ক্যাথলিকের ধারণা ছিল- নতুন পোপ সম্ভবত একজন তরুণ পুরুষ হবেন। তবে আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল বেরগোগলিওর বয়স তখন ‘সত্তর’ বছরের কাছাকাছি, যখন তিনি পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন। পোপ ফ্রান্সিসের ভ্যাটিক্যানের শাসন ব্যবস্থায় তাঁর সংস্কারের বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা বাধার সম্মুখীন হয়েছিল এবং তাঁর পূর্বসূরি, যিনি ২০২২ সালে মারা যান, তিনি ঐতিহ্যবাদীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের নতুনত্বের সংকল্প
পোপ ফ্রান্সিস নির্বাচিত হওয়ার আগে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি অন্যভাবে কাজ করবেন। তিনি তাঁর কার্ডিনালদের আনুষ্ঠানিকভাবে (পোপের সিংহাসনে বসে নয়) না করে, দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ১৩ মার্চ, পোপ ফ্রান্সিস সেন্ট পিটার স্কয়ারের বারান্দায় আসেন। তখন তিনি সাদা পোশাক পরিহিত ছিলেন এবং নতুন নাম গ্রহণ করেছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিসি-এর প্রতি সম্মানার্থে তিনি তাঁর নামটি রেখেছিলেন।
সরল ও সহমর্মিতার পোপ
১৯৯২ সালে পোপ ফ্রান্সিস বুয়েনস আইরেসে সহকারী বিশপ নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে আর্চবিশপ হন। ২০০১ সালে পোপ জন পল তাঁকে কার্ডিনাল নিয়োগ করেন এবং তিনি গির্জার সিভিল সার্ভিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পোপ ফ্রান্সিস একজন সরল মনের মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি উচ্চপদস্থ ধর্মগুরুদের শোভাযাত্রা থেকে অনেক কিছু এড়িয়ে চলতেন। ধর্মযাজকদের তথাকথিত ‘লাল’ কিংবা ‘বেগুনি’ পোশাকের পরিবর্তে সাদা ধর্মযাজকের পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে অসম অংশে বাস করি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এই অসমতা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে দরিদ্রতা মোটেও কমেনি।’ পোপ হিসেবে তিনি পূর্ব অর্থডক্স চার্চের সঙ্গে হাজার বছরের বিচ্ছেদ মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ, ৭৫০ বছর পর প্রথমবারের মতো কনস্ট্যানটিনোপলের প্যাট্রিয়ার্ক রোমের নতুন বিশপের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তিনি ফ্রান্সিস অ্যাঙ্গলিকান, লুথারান এবং মেথোডিস্টদের সঙ্গে কাজ করেন। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রপ্রধানদের শান্তির জন্য রাজি করিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ইসলামকে সহিংসতার সঙ্গে চিহ্নিত করা উচিত নয়। যদি আমি ইসলামী সহিংসতার কথা বলি, তবে আমি ক্যাথলিক সহিংসতার কথাও বলব।’ রাজনৈতিকভাবে তিনি আর্জেন্টিনার সরকারের ‘ফকল্যান্ড’ দ্বীপ নিয়ে দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। এ ছাড়া একজন স্পেনিশ ভাষাভাষী ল্যাতিন আমেরিকান হিসেবে তিনি কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক পুনর্মিলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
শৈশব থেকে পরিশ্রমী ছিলেন ফ্রান্সিস
সদ্যপ্রয়াত ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের আসল নাম জর্জ মারিও বেরগোগলিও। ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে এক ইতালীয় অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবা-মা ইতালির তৎকালীন ফ্যাসিজম শাসনের অবস্থা থেকে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় চলে এসেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি নাইট ক্লাব বাউন্সার ও ফ্লোর সুইপার হিসেবে কাজ করেছিলেন। তারপর রসায়নবিদ হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একজন রসায়নবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। তরুণ ফ্রান্সিস ছিলেন ট্যাঙ্গো নাচের কঠিন ভক্ত। এমনকি স্থানীয় ফুটবল ক্লাব সান লরেঞ্জোর সমর্থকও ছিলেন। ফ্রান্সিস একটি স্থানীয় কারখানায়, এস্টার বালেস্ট্রিনোর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। এস্টার বালেস্ট্রিনো আর্জেন্টিনার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মযাজক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং জেসুইট (খ্রিস্টের সৈনিক, পোপ পদীয় সৈনিক) হয়ে ওঠেন। যদিও রোমের ইতিহাসে জেসুইটদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো। পোপ ফ্রান্সিস দর্শন, সাহিত্য এবং মনোবিজ্ঞানে পাঠদান করেছিলেন। ১০ বছর পর তিনি ধর্মযাজক হিসেবে আচার্য হলেন। অবশেষে ১৯৬৯ সালে যাজক হিসেবে নিযুক্ত হন। অতঃপর ১৯৭৩ সালে আর্জেন্টিনার প্রদেশীয় অভিভাবক হয়ে ওঠেন।
গাজার গির্জার খোঁজ রাখতেন পোপ
ভ্যাটিক্যান সিটির সদ্যপ্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস এমন একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন; যিনি যুগের চাহিদা বুঝে গির্জাকে মানবিক ও সমবেদনাপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে যুগান্তকারী পোপ হিসেবে স্মরণীয় করে রাখবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত- ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে অনেকবারই কথা বলেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি গাজা উপত্যকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
বিবিসির নিউজ আওয়ার অনুষ্ঠানে গাজার হলি ফ্যামিলি গির্জার যাজক ফাদার গ্যাব্রিয়েল রোমানেলি বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে পোপ প্রতিদিনই তাঁদের ফোন দিতেন। তাঁরা নিরাপদ আছেন কি না, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন। পোপ কয়েকটি আরবি বাক্যাংশও শিখেছিলেন। রোমানেলি বলেন, সর্বশেষ গত শনিবার পোপের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। পোপই তাদের ফোন দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। পোপের জন্য প্রার্থনা করায় গির্জার সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পোপের এমন ঘনিষ্ঠতা... আমাদের জন্য ছিল প্রভুর দয়া ও উৎসাহের এক স্পষ্ট ও শক্তিশালী বার্তা- যা তাঁর গির্জায় তাঁর সেবা করার আহ্বান।’
টিয়ার্স রুম : এই ঘর থেকে নতুন পোপ প্রথমবারের মতো তাঁর পোশাক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গ্রহণ করবেন। যার মধ্যে রয়েছে সাদা রঙের ক্যাসক, একটি কেপ (মোজ্জেত্তা), সাদা টুপি (জুকেট্টো)। ঘরটির নাম ‘টিয়ার্স রুম’ রাখা হয়েছে- কারণ, আগের অনেক পোপ সেখানে ঢুকে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেছেন।
পোপ ফ্রান্সিস গির্জার সীমা প্রসারিত করেন, তবে তা ভাঙেননি
পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিক্যান সিটিকে আরও খোলামেলা এবং কম রহস্যপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার এই পোপ বিশ্বের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখদুর্দশাকে আবারও রোমান ক্যাথলিক গির্জার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিলেন। এসব মানুষের জন্য তিনি ছিলেন এক আকর্ষণীয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ বক্তা। তাঁর নেতৃত্বে গির্জা এমন এক সময়ে আরও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে, যখন প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক কেলেঙ্কারি ও যৌন নির্যাতনের ঘটনায় জর্জরিত ছিল। ২০১৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তাঁর পোপিয়ালে- তিনি ভ্যাটিক্যানের কিছু গোপনীয়তা সরিয়ে দেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। পোপ ফ্রান্সিস গির্জার ক্ষমতার অপব্যবহারকে নিন্দা করেন এবং অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পূর্বসূরি বেনেডিক্ট ষোড়শ থেকে ভিন্ন। পোপ বেনেডিক্ট বিশ্বাস করতেন, গির্জার সবচেয়ে অনুগত বিশ্বাসীদের লালন-পালন করাই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার উপায়। তবে ফ্রান্সিসের পরিবর্তন গির্জার বিতর্কিত শিক্ষার মৌলিক পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি আগের পোপদের মতোই অবস্থান বজায় রেখেছেন- সমকামী বিবাহ, নারীদের যাজক হওয়া এবং যাজকদের বিয়ে করার বিরোধিতা করেছেন।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার যাজকদের প্রধান নিযুক্ত হন- এটি রোমান ক্যাথলিক যাজকদের একটি আদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সে সময় তিনি ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ নেতা। তখন ল্যাতিন আমেরিকায় যাজকদের মধ্যে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব (Liberation Theology) জনপ্রিয় ছিল- এটি গসপেলের একটি বামপন্থি ব্যাখ্যা, যা দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণের পক্ষে কথা বলে। তবে তিনি এই মতাদর্শের অনুসারী নন।
তার নেতৃত্বকাল আর্জেন্টিনার ‘ডার্টি ওয়ার’-এর সময়ের সঙ্গে মিলে যায়, যা ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এই সাত বছর ছিল এক নির্মম সামরিক স্বৈরশাসন। এই সময় হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন, হত্যা ও গুম করা হয়। সে সময় আর্জেন্টিনার গির্জার ভূমিকা আজও বিতর্কিত। পোপ ফ্রান্সিস খোলামেলা সেই শাসনব্যবস্থার নিন্দা করেননি। ১৯৯৯ সালের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আসুন আমরা প্রার্থনা করি... সমাজের সকল বড় অংশ ও গির্জার নীরব সহমর্মিতার জন্য।’
পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে এক ভাষণে ইসলামকে সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত করেন। ফলে মুসলিমদের সঙ্গে গির্জার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। এর বিপরীতে, পোপ ফ্রান্সিস প্রথম যিনি আরব উপদ্বীপে সফর করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে কায়রোর আল-আজহার মসজিদের প্রধান ইমাম আহমেদ আল-তাইয়েবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁরা যৌথভাবে একটি দলিলে স্বাক্ষর করেন; যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ‘ভাই’ হিসেবে দেখার আহ্বান জানানো হয়।
পোপের মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা...
পোপের মৃত্যুর পরই শুরু হয় নতুন এক পর্ব- যা শুধু ধর্মীয় নয়; ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে আছে প্রাচীন প্রথার সঙ্গে। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন ‘ক্যামেরলেনগো’ (ভ্যাটিক্যানের এক জ্যেষ্ঠ কার্ডিনাল)। তাঁর সামনে পোপের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। এক সময় প্রচলিত ছিল, ক্যামেরলেনগো পোপের কপালে রুপার হাতুড়ি দিয়ে তিনবার আঘাত করে তার নাম ধরে ডাকতেন- প্রতিউত্তর না পেলে মৃত ঘোষণা করা হতো। বর্তমানে ক্যামেরলেনগোর সিল করে দেন পোপের ব্যক্তিগত কক্ষ, ভেঙে ফেলেন ‘ফিশারম্যান রিং- যেটি দিয়ে পোপ দলিল সিল করতেন। ২০২৪ সালের পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কনক্লেভ’-এ (Conclave) এই প্রক্রিয়াটি নাটকীয়ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। পোপের মৃত্যু-পরবর্তী সময়কে বলা হয় ‘সেদে ভাকান্তে’ যার অর্থ ‘সিংহাসন শূন্য’। তখন চার্চের প্রশাসনিক দায়িত্ব নেয় কার্ডিনালদের একটি দল। তবে এর আগে ‘জেনারেল কনগ্রেগেশন’ নামে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে চার্চের বর্তমান নানা সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। এখানে সব কার্ডিনাল যারা বৈধ কারণে বাধাগ্রস্ত নন, তাদের এই সভায় উপস্থিত থাকা আবশ্যক। পোপের মৃত্যুর ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল থেকে শুরু হবে মূল আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব কার্ডিনালকে ভ্যাটিক্যানে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সময় দেওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত। সিস্টাইন চ্যাপেলে শুরু হয় পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া এবং ঐতিহাসিক ‘কনক্লেভ’। বর্তমানে ২৫০ জনের বেশি কার্ডিনাল রয়েছেন, যাদের সবার পোশাকের বৈশিষ্ট্য হলো- ‘লাল চাদর’। ‘কনক্লেভ’-এ ভোট দেওয়ার যোগ্য কার্ডিনালদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২০ এবং তাদের বয়স অবশ্যই ৮০ বছরের কম হতে হবে।
পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া
পোপের মৃত্যু থেকে পরবর্তী পোপ নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টিকে বলা হয় ‘সেদে ভাকান্তে’ যার অর্থ ‘সিংহাসন শূন্য’। পোপকে নির্বাচন করবে ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’। তাঁরা ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, যাদের পোপ নিজেই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তারা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রোমে যাবেন; কনক্লেভে অংশ নেবেন। ৯০টিরও বেশি দেশের ২৫০-এর বেশি কার্ডিনাল থাকলেও ভোটাধিকার রয়েছে মাত্র ১৩৫ জনের (৮০ বছরের বেশি বয়সিদের নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়)। এই ভোটারদের মধ্যে প্রায় ১১০ জনকে গত ১০ বছরে পোপ ফ্রান্সিস নিজেই নিয়োগ দিয়েছেন। তারা মূলত তাঁর অধিক অন্তর্ভুক্তি-মূলক চার্চ গঠনের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করেন। পোপের মৃত্যুর ১৫-২০ দিনের মধ্যে কার্ডিনালরা রোমে একত্রিত হন এবং সিস্টিন চ্যাপেলে আলোচনা শুরু করেন। ‘extra omnes’ -যার অর্থ ‘সবাই বের হয়ে যাও’।
এই ঘোষণার পর ভোটার কার্ডিনাল ও কয়েকজন কর্মকর্তা ও ডাক্তার ছাড়া সবাইকে বের করে দেওয়া হয় এবং দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্ডিনালরা কঠোর গোপনীয়তার শপথ গ্রহণ করেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ভোট নেওয়া হয়, যতক্ষণ না কোনো প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। প্রতি সাতটি ভোটের পর এক দিনের বিরতি রাখা হয় প্রার্থনা ও চিন্তার জন্য। প্রতিটি নির্বাচককে একটি ব্যালট কার্ড দেওয়া হয়, যার ওপরে লেখা থাকে eligo in summum pontificem (আমি সর্বোচ্চ ধর্মগুরু নির্বাচন করছি)। তারা পছন্দের ব্যক্তির নাম লিখে ব্যালট ভাঁজ করে একটি পাত্রে ফেলেন। প্রতিটি ভোটপর্বের পর ব্যালট কার্ডগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। ধোঁয়ার রং নির্ধারণ করতে রাসায়নিক পদার্থ যোগ করা হয়। ৬০ ফুট উঁচু চিমনি থেকে যদি কালো ধোঁয়া বের হয়, তবে বুঝতে হবে ভোটে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি; আর সাদা ধোঁয়া নির্দেশ করে, নতুন ‘পোপ’ নির্বাচিত হয়েছেন।
ভ্যাটিক্যান সিটি কেন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ?
ভ্যাটিক্যান সিটির বৈশ্বিক গুরুত্ব মূলত ক্যাথলিক চার্চের কেন্দ্র এবং পোপের আবাসস্থল হিসেবে এর ভূমিকায় নিহিত। যেখানে পোপ একজন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যার উপস্থিতি গির্জার নেতৃত্ব এবং আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার প্রতীক। এটি মূলত কোটি কোটি ক্যাথলিক অনুসারীদের তীর্থস্থান, ধর্মীয় শিল্প ও স্থাপত্যের ভান্ডার। ভ্যাটিক্যান সিটি কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পোপের যে কোনো বিবৃতি ও হোলি সির কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটি বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
► ভ্যাটিক্যান সিটি ক্যাথলিক গির্জার সদর দপ্তর এবং পোপের বাসস্থান, যিনি ক্যাথলিক গির্জার নেতা এবং এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান।
► সেন্ট পিটার্স বাসিলিকা, বিশ্বের ক্যাথলিক অনুসারীদের জন্য একটি প্রধান তীর্থস্থান। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এখানে আসেন।
► ভ্যাটিক্যানে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেমন- পোপ পরিচালিত মেস, পোপ নির্বাচন এবং ইস্টার ও বড়দিন উদ্যাপন।
► বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিকদের জন্য ভ্যাটিক্যান আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার উৎস; যা ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা ও যাজকীয় সহায়তা প্রদান করে।
► এখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত ধর্মীয় শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য। যেমন- সেন্ট পিটার্স বাসিলিকা, সিস্টিন চ্যাপেল এবং ভ্যাটিক্যান জাদুঘর।
নতুন পোপ কে?
কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা এক জটিল প্রক্রিয়া মেনে অতিগোপনে নতুন পোপ নির্বাচন করা হয়। কে হতে যাচ্ছেন নতুন পোপ, তা জানা কঠিন। তবুও ক্যাথলিক চার্চের গুরুদায়িত্ব কার কাঁধে যাচ্ছে, তা অনুমান করা যায়।
০১. জঁ-মার্ক অ্যাভেলিন [বয়স ৬৬] : তিনি অভিবাসীদের প্রতি সহানুভূতির জন্য পরিচিত। যুদ্ধের কারণে তাঁর পরিবার ফ্রান্সে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় ক্যাথলিক মহলে তিনি ‘জন চতুর্বিংশ’ নামে পরিচিত। দর্শনে ডিগ্রিধারী অ্যাভেলিন ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি করেছেন।
০২. জোসেফ টোবিন [বয়স ৭২] : জোসেফ টোবিন ক্যাথলিক চার্চের অতি প্রগতিশীল প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। চার্চে নারীদের ভূমিকা ও অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন এই যাজক।
০৩. জুয়ান হোসে ওমেলা [ বয়স ৭৯ ] : স্পেনিশ কার্ডিনাল জুয়ান হোসে ওমেলা পোপ ফ্রান্সিসের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। আর্চ বিশপ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যে কার্ডিনালের ‘লাল চাদর’ অর্জন করেন।