বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ঘরোয়া আসরের নাম স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসবে। যার যাত্রা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের মাধ্যমে। ৭৭ বছরের ইতিহাসে ঘরোয়া আসরে কত যে বিখ্যাত দেশিবিদেশি খেলোয়াড়ের দেখা মিলেছিল তার হিসাব মেলানো মুশকিল। তারকার খ্যাতিটা এসেছিল মাকরানি ফুটবলারের মাধ্যমেই। মাকরানি আবার বিদেশি খেলোয়াড় নন। তারা লিগে অংশ নিতেন দেশি খেলোয়াড় হিসেবে। তাদের আগমন মূলত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পূর্ব বা পশ্চিম দেশটা তখন একটাই-পাকিস্তান। সে ক্ষেত্রে মাকরানিদের তো আর বিদেশি বলা যাবে না। অনেকের কাছে মাকরানি শব্দটা অচেনা হতে পারে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তো একেবারে অজানা।
প্রশ্ন হচ্ছে-বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যে পশ্চিম পাকিস্তানি ফুটবলাররা ঢাকা লিগে দাপটের সঙ্গে খেললেন তাদের অধিকাংশকে মাকরানি বলা হয় কেন? দেশের ফুটবলে খুবই পরিচিত মুখ গোলাম সারোয়ার টিপু তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেলেছেন। তিনিই বিষয়টি খুলে বললেন, ‘করাচির পাশে মাকরান বলে ছোট এক এলাকা রয়েছে। যারা ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় পারদর্শী। বিশেষ করে ফুটবলে মাকরানের খ্যাতি ছিল অন্য রকম। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে তাদের প্রাধান্য ছিল। মাকরান থেকেই মাকরানি। এরাই পরে ঢাকা লিগে খেলতে আসেন। অনেকে আবার কলকাতা লিগেও খেলেন। সম্ভবত ১৯৫৬ বা ’৫৭ সালের দিকে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে প্রথম মাকরানির আগমন ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি কিকার্সে খেলা ইমাম বক্সকে দলভুক্ত করে পিডব্লিউডি। সেই থেকে মাকরানিরা একের পর এক আসতে থাকেন। মাকরানিদের খেলার মান এতটাই উন্নত ছিল যে প্রায় প্রতিটি ক্লাবই তাদের নাম রেজিস্ট্রেশন করত। মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, আজাদ, দিলকুশা, পিডব্লিউডির সেরা একাদশে অর্ধেক থাকতেন মাকরানিরা। ইপিআইডিসিতে (স্বাধীনতার পর বিজেএমসি) তো ১০ জনই ছিলেন মাকরানি।’
এ তো গেল মাকরানিদের কথা। স্বাধীনতার পরই ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে প্রথম বিদেশি ফুটবলারের দেখা মেলে। ১৯৭৪ সালে মোহামেডান ভারত থেকে প্রসাদ ও মিশ্র নামে দুজন ফুটবলারকে খেলায়। সেই থেকে বিদেশির আগমন। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ফুটবলাররা খেলেছেন বা খেলছেন। ১৯৮৭ সালে আবাহনীই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা ইরাকের শামির সাকি ও করিম মোহাম্মদকে খেলায়। পালাবদল এখানেই শেষ নয়। পেশাদার লিগেই প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসী ফুটবলারের দেখা মেলে। ডেনমার্কপ্রবাসী জামাল ভূঁইয়াই প্রথম প্রবাসী হিসেবে লিগ খেলেন এবং জাতীয় দলেও আস্থার পরিচয় দিচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনিই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জামালের অভিষেকটা হয় শেখ জামাল ধানমন্ডি থেকে। ফিনল্যান্ডের তারিক কাজী হচ্ছেন দ্বিতীয় প্রবাসী ফুটবলার। তিনি শুরু থেকেই বসুন্ধরা কিংসে খেলছেন। কানাডাপ্রবাসী কাজিম শাহ খেলছেন পুলিশ এফসিতে। জামালের মতো তাঁরাও জাতীয় দলেই খেলছেন। ধানমন্ডি ক্লাবের নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ১৯৮৬ সালে তারাই প্রথম ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার উড়িয়ে আনে। তা-ও আবার একসঙ্গে চারজন। চমক থাকলেও তারা ততটা মানসম্পন্ন খেলোয়াড় ছিলেন না। মাকরানি ফুটবলার আবার বিদেশি হিসেবে খেলেন ১৯৭৭ সালে। সেবার কালা গফুরকে মোহামেডানে অন্তর্ভুক্ত করে। ৭৭ বছরের ইতিহাসে লিগে কত কিছুই না দেখা গেছে। যার সর্বশেষটা জাতীয় দলের মাধ্যমে। পৃথিবীর বিখ্যাত লিগ খেলা ফুটবলাররা এখন জাতীয় দলের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় হিসেবে ফিফার অনুমতি নিয়ে হামজা দেওয়ান চৌধুরী, সামিত সোম ও ফাহামিদুল ইসলামরা গর্বের লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন। কিউবা মিচেল ছাড়াও সামনে আরও প্রবাসীকে বাংলাদেশে দেখা যাবে।
এ পথটা মূলত বসুন্ধরা কিংস দেখিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। পেশাদার লিগে খেলতে আসা নাইজেরিয়ান এলিটা কিংস্লে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এ ক্লাবে খেলেই। কিংস তাঁর সব কাগজপত্র ঠিক করে দিয়েছে। কিংস শুরু থেকে বিশ্বকাপ খেলা কোস্টারিকার ড্যানিয়েল কলিনড্রেস, সেই সঙ্গে ব্রাজিলের রবসন রবিনহোর মতো উন্নতমানের বিদেশি এনে চমক দেখায়। এ থেকেই ভাবনা শুরু হয় নাগরিকত্ব দিয়ে বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে খেলানোর ব্যাপারটি। হামজা, সামিত, ফাহামিদরা মূলত বাফুফের উদ্যোগে এলেও বসুন্ধরা কিংসের সহযোগিতা ছিল স্পষ্ট। কিউবা মিচেলতো বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছেন কিংস সভাপতি ইমরুল হাসানের উদ্যোগে।
মাকরানি, বিদেশি ও প্রবাসীরা স্থানীয়দের সঙ্গে খেলে দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন। মাকরানি খেলোয়াড়দের মধ্যে মুসা, কাদের বক্স, রসুল বক্স, আবিদ, ওমর, আসলাম, জব্বার, মওলা বক্স, তোরাব আলি, আমির বক্স, আইয়ুবদার, খোদা বক্স, আবদুল্লাহ, আলি নেওয়াজদের ছন্দ দেখে ফুটবলপ্রেমীরা নেচেছেন। তেমনি বিদেশিদের মধ্যে লাওন পিরিচ, পাকির আলি, এমেকা, নালজেগার, বিজন তাহেরি, জুকভ, রহিমভরা গ্যালারি মাতিয়েছেন। এ ছাড়া সুলেমান দিয়াবাতের মতো বিদেশিরা নজর কাড়ছেন। এখন আবার জাতীয় দলে হামজারা মাতাচ্ছেন। এত বিবর্তনে ফুটবলের মান কবে উন্নত হবে সেটাই এখন অপেক্ষা।