ভারতীয় সীমান্ত এলাকা ডাউকি থেকে ট্যাক্সি ছুটছে শিলংয়ের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরই উচ্চতাজনিত চাপে কান বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আরও কিছুটা এগোতেই শুরু হলো কনকনে শীত। বাংলাদেশে মার্চের গরম ছেড়ে হঠাৎ করে শীতের রাজ্যে প্রবেশ করে মানিয়ে নেওয়া কঠিন বটে। এখানেই শেষ নয়। ট্যাক্সি আরও কিছুদূর যেতেই রাস্তায় নেমে এলো অন্ধকার। হেডলাইট জ্বালিয়েও ২০ ফুটের বেশি দৃষ্টিসীমা উদ্ধার করার উপায় নেই। রাশি রাশি মেঘমালা ঢেকে রেখেছে সাপের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। একটু এদিক-ওদিক হলেই হাজার হাজার মিটার নিচে উল্টে পড়ার ভয়। সুদক্ষ ড্রাইভার হারমান অবশ্য নিরাপদেই এগিয়ে গেলেন মেঘের রাজ্য শিলংয়ের পথে। এই শিলংয়েই দুই দিন পর ফুটবল লড়াইয়ে নামবে বাংলাদেশ-ভারত। যে ম্যাচ ঘিরে দুই দেশের ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। লিস্টার সিটির জার্সিতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দ্বিতীয় স্তরে খেলা হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে নিয়ে নতুন স্বপ্নের জাল বুনছে বাংলাদেশের সমর্থকরা। আর ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা? তারাও বেশ সচেতন হামজাকে নিয়ে। অনেকে এরই মধ্যে তার ভক্তও বনে গেছেন!
শিলংয়ের খাসিয়া উপজাতির টিলেন পেশায় ট্যাক্সি ড্রাইভার। তার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, খুবলাই। অবাক হয়ে তাকাতেই ইংরেজিতে বললেন, ওয়েলকাম। খাসিয়া ভাষায় খুবলাই মানেই স্বাগত। নতুন অতিথিদের এভাবেই স্বাগত জানান তারা। একথা-ওকথার পর টিলেনের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানা গেল। বিশেষ করে হামজা চৌধুরীর কথা। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের টিকিট কিনে নিয়েছেন তিনি। সেদিন আর কোনো কাজ করবেন না। কেবল ফুটবল। হামজার কথা উঠতেই বললেন, ‘তোমাদের যে ছেলেটা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলছে তিনিই তো হামজা?’ মেঘালয়ে মেঘের আড়ালে হামজা চৌধুরী দুর্দান্ত দাপটেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি ও ভারতীয় মিডিয়ার জোর প্রচারণায় হামজার বাংলাদেশি পরিচয় এতদিনে এ উপমহাদেশের প্রায় সবার জানা হয়ে গেছে। ভারতীয়রা একটু বেশিই জেনেছে। কারণ পুরোনো ইতিহাস বদলে দেওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে ছুটছে বাংলাদেশ দল, তার প্রধান কারিগর তো হামজাই।
শিলংয়ে ফুটবল নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি হয়। টিলেন ড্রাইভারই বলছিলেন, এ অঞ্চলে সবাইকেই ফুটবল-পাগল বলতে পারো। এর অবশ্য কারণও আছে। শিলং লাজং এ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে আই লিগে। তা ছাড়া আইজল এবং নর্থইস্ট ইউনাইটেডও এ অঞ্চলেরই দল। গত বছর ডুরান্ড কাপ জয় করেছে নর্থইস্ট ইউনাইটেড। ফুটবলের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের দুর্বলতা অনেক। ড্রাইভারদের বেশির ভাগই গাড়ির পেছনে এক জোড়া বুট নিয়ে চলেন। সুযোগ পেলেই তারা ফুটবল খেলতে নেমে যান। ফুটবল-পাগল এ মানুষগুলোর কাছে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের গুরুত্ব অনেক। তারা সুনীল ছেত্রীর ওপর আস্থা রাখছেন। আবার হামজা চৌধুরীকে ভয়ও পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল এরই মধ্যে দুটি সেশন অনুশীলন করেছে শিলংয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত শহরে বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চল থেকে হঠাৎ করে এলে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করা কঠিন। অনুশীলনে ঘাম ঝরানোর পাশাপাশি আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করছেন জামাল-হামজারা। কোচ হাভিয়ের কাবরেরা দলটার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের একটা স্ফুরণ এনে দিয়েছেন। লাল-সবুজ জার্সিধারীদের শরীরী ভাষাও বদলে গেছে। বহু বছর পর ভারত জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ছুটে এসেছেন তারা। সেই লক্ষ্যেই চলছে অনুশীলন।
অনুশীলনে কোনো কমতি রাখছেন না সুনীল ছেত্রীরাও। তাদেরটা চলছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফুটবলে যাকে ‘ক্লোজড ডোর’ বলে। সেখানে বাংলাদেশি সাংবাদিক তো বটেই, ভারতীয়দের প্রবেশেও রয়েছে নানা বিধিনিষেধ। শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ভারতীয় ফুটবল দল অনুশীলন করলেও জামাল ভূইয়ারা এখনো সুযোগ পাননি। অবশ্য ম্যাচ খেলার আগে অন্তত একটা সেশন এই মাঠে অনুশীলন করতে পারবেন তারা। এই একটা সেশনেই শিলং স্টেডিয়ামের নাড়ি-নক্ষত্র নখদর্পণে নিতে হবে কাবরেরার শিষ্যদের।