আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-ভিত্তিক অপপ্রচার, গুজব মোকাবিলাই বড় চ্যালেঞ্জ। আর তা মোকাবিলায় সঠিক তথ্য মূলধারার গণমাধ্যমকে তাৎক্ষণিকভাবে সরবরাহের পরামর্শ দিলেন সংবাদকর্মীরা।
সোমবার (৬ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে আয়োজিত সংলাপে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন।
সংলাপে একাত্তর টিভির বার্তা প্রধান শফিক আহমেদ বলেন, সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের মর্যাদা মন্ত্রীর ওপরে রাখতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ। ইসি কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। বিনা ভোটের প্রার্থী নির্বাচন ঠেকাতে একক প্রার্থীর আসনে পুনরায় ভোটের আয়োজন। একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার বিধান করা, যাতে দলগুলোর মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হয়। গণমাধ্যমে ভোটের খবর সংগ্রহ করতে নীতিমালা সহায়ক না। এতে আমরা কারচুপির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরতে পারবো না। কাজেই গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক নীতিমালা করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভোটের সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো যেতে পারে। এটা নিয়ে দল ও সংস্কার কমিশন কথা বলেছে। যে কোনো অভিযোগ গ্রহণ ও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কেন্দ্র করার প্রয়োজন। এআই-ভিত্তিক ষড়যন্ত্র বা বিভ্রান্তি মোকাবিলায় গণমাধ্যম ভূমিকা পালন করবে, এমন আশ্বাসও দেন তিনি।
যমুনা টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমে অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটা আসলে আইনি বিষয় না।
পুলিশ-প্রশাসনের দায়দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে। কেননা, তাদের মধ্যে একটা মনোভাব কাজ করতে পারে যে দায়িত্ব শেষ করলে বাঁচি। কারণ, তারা যেন ভোটের পরে ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে না পড়েন। রাতের ভোট হয়েছে, এতে প্রিসাইডিং অফিসারের ভূমিকা ছিল। কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছেন কে? সিইসি। কাজেই এই বিষয়গুলো দেখতে হবে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক (সিএনই) মোস্তফা আকমল বলেন, বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার। যেকোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে যদি কোনো নারী কেলেঙ্কারি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু তিনি ড্যামেজ হয়ে যাবেন। এআই দিয়ে এক-দু’মিনিটের মধ্যে একটা ভুয়া ছবি তৈরি করে ফেলা যায়। ব্যাপক লোকজন নিয়োগ করে কিন্তু প্রোপাগান্ডা চলছে। এটা ইসিকে মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি-বাড়ি কিন্তু সেভাবে যাওয়া হয়নি। যারা বাদ পড়েছে, তাদের যদি কোনো সহজ প্রক্রিয়ায় ভোটার করে নেওয়া হয়, ভালো হবে।
তিনি বলেন, আপনারা যত দ্রুত আমাদের সঠিক তথ্য দেবেন, আমরা তত দ্রুত প্রচার করবো। এতে প্রোপাগান্ডা, গুজব রোধ করা সম্ভব হবে। ভোট গণনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্য সোর্স থেকে তথ্য নিয়ে প্রচার করলে ভুল হওয়ার সুযোগ থাকে। তাই আপনারা যত দ্রুত ফলাফল প্রকাশ করতে পারেন, যদি ইসি থেকে কোন কেন্দ্রে কত ভোট পড়লো দ্রুত দিতে পারেন, তাহলে আমাদের আর মাঠে প্রতিনিধির কাছ থেকে নিতে হয় না। আর আমাদের দেশের এমন প্রবণতা আছে যে, টিভিতে বলেছে মানে আমি জিতেছি। কাজেই আমাদের যত দ্রুত সম্ভব কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য দেন তাহলে আর ভুল বোঝাবুঝি হবে না।
গ্লোবাল টিভির সিএনই ফেরদৌস মামুন বলেন, ৫ আগস্টের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাটা কমে গেছে। এখনো পুরোপুরি আসেনি। আস্থা ফেরানোর ব্যাপারে ইসির উদ্যোগ কী, সেটা জানা দরকার। সামনের নির্বাচন অনেক কঠিন হবে।
তিনি বলেন, মূলধারার গণমাধ্যম ইসির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে না। মূল সমস্যা তৈরি করবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। গুজব এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। কমিশনকে এজন্য একটা কাঠামো বা সিস্টেম তৈরি করতে হবে, এটা ঠেকানোর জন্য।
চ্যানেল আই-এর জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার সুযোগ সৃষ্টিতে আমাদের সক্ষমতা আছে কিনা এবং মিশনগুলোর কর্মকর্তারা প্রবাসীদের বিষয়ে আন্তরিক কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। পোস্টাল ব্যালট করা গেলে আমরা ভবিষ্যতে ফিজিক্যাল ভোটদান থেকে হয়তো বেরিয়ে যেতে পারবো।
তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে প্রতিদিন ব্রিফ হওয়া উচিত। আপনাদের কাছে মনে হতে পারে তথ্য নেই। কিন্তু সেটা আমাদের প্রয়োজন হতে পারে।
তিনি বলেন, মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন, এআই এবারের নির্বাচনের জন্য ভয়ংকর। আগামীকাল কেউ দেখিয়ে দিতে পারে সিইসি একতারা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। ফ্যাব্রিকেটেড করে দেখিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় মানুষ বিশ্বাস করতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করতে চান। অনেকেই বিশ্বাস না চাইলেও নিজের স্বার্থে ছড়িয়ে দিতে পারে। ৪০ শতাংশ মানুষ মিসইনফরমেশন বিশ্বাস করে।
ডিবিসি টিভির সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, সংস্কার কমিশন অনেকগুলো কাজ এগিয়ে দিয়েছে, এজন্য আপনারা অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ দেরি করছেন। কিন্তু আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, সেগুলো আমলে না নিয়েই যদি নীতিমালা করেন তাহলে তো আজকের এই সংলাপ ফলপ্রসূ হলো না। কাজেই নীতিমালা সংশোধন করা উচিত।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এটা করতে পারবেন কিনা, এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আপনারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন, আমরা ভুল-ত্রুটি ধরার চেষ্টা করবো। কিন্তু সেটা আপনাদের আমলে নিতে হবে। আমরা অতীতেও দেখেছি, গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ ভাবা হয়। তাই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারবেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন যদি আমলে নিয়ে প্রতিপক্ষ ভাবেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য গোপন করা হয়, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। হলফনামা যেটা দিল, আমরা জানি ভুয়া, কিন্তু ইসি সেটা তদন্ত করে দেখলো না। সেটা হলে তো আর হলফনামা দেওয়ার দরকার নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকসহ বেসরকারি চাকরিজীবীরা যেন পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা উচিত।
এটিএন নিউজের হেড অফ ইনপুট শহিদুল আজম বলেন, গণমাধ্যমকে আমরা পার্টনার বলছি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, একটা বাধা তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, অপতথ্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যারা নিবন্ধিত গণমাধ্যম, তাদের অনেক নিয়মনীতি মানতে হয়। কিন্তু যার একটি মোবাইল আছে বা ইউটিউব চ্যানেল আছে, তিনিই কিন্তু নিজেকে সংবাদকর্মী মনে করে। কাজেই তিনি যখন কোনো নিউজ পান, আপনারা আটকাতে পারবেন না। কাজেই ইসির তথ্যের শাখাকে আরও বড় করতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে। যদি তথ্যের বিলম্ব হয়, তাহলে কিন্তু গুজব সহজে বাড়ে। নির্বাচনে ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যা সেন্টার থেকে আসবে, সেটা রিটার্নিং কর্মকর্তা হয়ে আসতে অনেক দেরি হয়। যেটা চাপিয়ে রাখা যাবে না, সেটা উন্মুক্ত করে দেওয়াই ভালো। তাহলে কোনো সংশয়, সন্দেহ থাকবে না।
দীপ্ত টিভির সিএনই এসএম আকাশ বলেন, গুজব রুখতে মিডিয়াকে অবাধ করে দিতে হবে। মিডিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনাদের অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এজন্য নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এআই মোকাবেলায় ফ্যাক্ট-চেকিং টিম গঠন করা যেতে পারে। এটা আমাদের দিলে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রচার করতে পারি। এতে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে।
সময় টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জনি বলেন, গুজব তৈরি হলে, সাথে সাথে কমিশনকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তখনই জানাতে হবে। সেটা কমিশনকে সঙ্গে সঙ্গে মূলধারার গণমাধ্যমকে এনশিওর করতে হবে।
নিউজ২৪-এর হেড অফ নিউজ শরিফুল ইসলাম খান বলেন, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। ভোট মানেই এক সময় ফেস্টিভ মুড ছিল। ধীরে ধীরে এটা রক্তক্ষয়ী অবস্থায় চলে আসছে। শুধুমাত্র কাগজ দিয়ে, আইন দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক হবে গণমাধ্যমের এমন স্বাধীনতা দিতে হবে। এতে ইসিরও লক্ষ্য পূরণ সহজ হবে।
বৈশাখী টিভির বার্তা প্রধান কবির সুমন বলেন, নির্বাচনের ফলাফল পেতে যদি আমাদের দেরি হয়, তাহলে গুজব ডালপালা বাড়তে পারে। তাই আমার সুনির্দিষ্ট দাবি, যারা জনসংযোগের দায়িত্বে আছেন তারা কোনো সেল করে দিতে পারেন কিনা। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে যারা হেড অফ নিউজ আছেন, তারা নির্বাচনের সাত দিন আগে কোনো হোয়াটসঅ্যাপ বা কোনো গ্রুপ করে দিতে পারেন কিনা, যেখানে তারা কোনো ইনফরমেশন দেবেন বা আমাদের কোনো ইনফরমেশন দেওয়ার থাকলে পাবো।
বিটিভির বার্তা সম্পাদক মঈনুল ইসলাম বলেন, আপনাদের নির্দেশনায় কাজ করবো। সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারিতে রাখতে হবে। ফেক নিউজ ছড়াবে। দ্রুত আমাদের চিহ্নিত করে জানাবেন, যাতে আমরা কাউন্টার করতে পারি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা, স্টার নিউজের হেড অফ নিউজ ওয়ালিউর রহমান মিরাজ, মাছরাঙা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি নিয়াজ মোর্শেদ, আনন্দ টিভির নিউজ ইনচার্জ জয়নাল আবেদীন, এটিএন বাংলার চিফ রিপোর্টার একরামুল হক সায়েম সংলাপে অংশ নিয়েছেন।
সিইসি সকলের আলোচনা শেষে বলেন, অনেক মূল্যবান পরামর্শ এসেছে। আমরা যতটুকু পারি, আপনাদের পরামর্শ বিবেচনা করবো। আপনাদেরকে আমরা সত্যিকারের পার্টনার হিসেবে পেতে চাই। জনগণের কাছে আমাদের বার্তা একমাত্র মিডিয়াই পৌঁছাবে। আপনাদের ছাড়া কোনো উপায় নাই। আমরা মিডিয়াকে অ্যাক্সেস দিতে চাই। আমাদের নিয়তের মধ্যে কোনো গলদ নাই। নিয়ত একদম পরিষ্কার। মিডিয়ার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা।
তিনি বলেন, মাঠের বাস্তবতা নিয়ে সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকলের সহযোগিতা নিয়ে আমাদের চলতে হবে।
বিডি প্রতিদিন/আশিক