জুলাই আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হয়েছে। এই আন্দোলন সফলও হয়েছে। কিন্তু এক বছর পার হতেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জুলাইয়ের ঐক্য ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। গণমাধ্যমকেও দেশের স্বার্থে সঠিক তথ্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপহার দিতে হবে। তাহলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি হবে।
গতকাল রাজধানীর হোটেল লা-মেরিডিয়ানে নতুন গণমাধ্যম ‘বাংলা এডিশন’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।
বাংলা এডিশনের চেয়ারম্যান হলেন প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন ইলিয়াস হোসাইন। এ ছাড়া ড. কনক সারওয়ার, পিনাকী ভট্টাচার্য, ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। ইলিয়াস হোসাইন বলেন, আজকের এই দিনে আবু সাঈদ শহীদ হয়েছিল। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরেই দেশের মানুষ রাস্তায় নামে। ইংলিশ মিডিয়াম, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রিকশা শ্রমিক, গার্মেন্টসহ সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে শরিক হয়। তিনি বলেন, বিএনপি দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল। এই দলটি গত ১৬ বছর অনেক ত্যাগ দিয়েছে। বিএনপির মতো অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সেই ত্যাগ দিয়েছে। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের ত্যাগ রয়েছে। সবার ত্যাগেই আজকের এই বাংলাদেশ। পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, নতুন বাংলাদেশে অনৈক্য। একটা বিপ্লবের পর অনৈক্য এটা স্বাভাবিক। তবে এই অনৈক্য আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, তিনটা বিষয়ে একমত থাকলে দেশ কখনো বিপথে যাবে না। প্রথমত, দেশে কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, ভারতের আধিপত্য বিস্তার করতে দেওয়া যাবে না। তৃতীয়, ইনসাফের দেশ গঠন করতে হবে। এই তিনটা বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দল এক থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে। কনক সারওয়ার বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পতনের জন্য আমরা সবাই এক হয়েছিলাম। যে লক্ষ্য নিয়ে এক হয়েছি সেটা সফলও হয়েছে। কিন্তু এক বছর পর এখন সে ঐক্যটা আর দেখা যাচ্ছে না। তবে আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকুক।
তিনি বলেন, ১৬ জুলাই শহীদ দিবস। এই দিবসে বাংলা এডিশনের পথ চলা শুরু। আমরা নতুন মাত্রায় কাজ শুরু করেছি। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে চাই। দেশের গণম্যাধ্যমের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তবে দেশের অনেক গণমাধ্যম এখনো ফ্যাসিস্ট আমল থেকে বের হতে পারেনি। সেখান থেকে বাংলা এডিশনের নতুন পথযাত্রা। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ বলেন, ২৪ আন্দোলনের পর নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে তিনটা বিষয় দরকার। সেগুলো হলো- মিডিয়ায় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দেওয়া। এর জন্য দরকার সাহস, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দেওয়া। বাংলা এডিশন যেন এই বিষয়গুলো অব্যাহত রাখে। হলুদ সাংবাদিকতা পরিহার করা এবং ইতিহাস বিকৃত না করা। রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, জাতীয় ঐক্য চাই না, আমাদের দরকার গণ ঐক্য। আমাদের দরকার রাষ্ট্র গঠন। এরপর নির্বাচন। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দল চায় তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন। দলগুলোর এটা পরিহার করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র ও মিডিয়া, রাজনৈতিক দল ও মিডিয়া একসঙ্গে চলতে পারলে দেশে সুবাতাস বয়ে আনবে। বাংলা এডিশন সে কাজটা করবে। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কিছু জায়গায় ঐকমত্যে আসতে হবে। এর মধ্যে দলগুলোর মধ্যে একে অপরকে সম্মান দেখাতে হবে। পরস্পর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে। গণতন্ত্রের রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকে এই কাজ করতে হবে। আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিও পরিবর্তন করতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়্যারমেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার নিয়ে কথা হয়। এই সংস্কারে সব দল ঐকমত্যে আসবে না এটাই স্বাভাবিক। তাহলে তো এক দলই হতো। সবার নিজস্ব আদর্শ দিয়ে এতগুলো দল তৈরি হতো না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদেরকে বুদ্ধিহীন ভাববেন না। এই দেশে যারা আওয়ামী লীগের মতো রাজনীতি করবেন তাদেরও শেখ শেখ হাসিনার মতো পরিণতি হবে। অন্তত রাজনৈতিক নেতারা এই শিক্ষা নিয়েছেন।
এলডিপির সভাপতি ড. কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, আজ সংবাদপত্রের মালিক ব্যবসায়ীরা। কোনো প্রফেশনাল ব্যক্তিরা মিডিয়ার মালিক নেই। যেসব পত্রিকা ভারত প্রভাবিত সেগুলোর রেশ ভাঙতে হবে। ভারতীয় দালালমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বাংলা এডিশন যেন জুলুম, নির্যাতনের পক্ষে এবং সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপহার দেয়। আমাদের মধ্যে জুলাই ঐক্য ধরে রাখার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ঐক্য ফাটলের জন্য সরকার দায়ী। কারণ সচিবালয়ে আওয়ামী লীগ, পুলিশে আওয়ামী লীগ রয়েছে।
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলে দেশে দাসত্বের সাংবাদিকতা হয়েছিল। কিছু গণমাধ্যম সম্পাদক অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল। মানুষ দাসত্বের সাংবাদিকতা পছন্দ করে না। মানুষ অসহায় সাংবাদিকতা পছন্দ করে না। হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমও দায় এড়াতে পারে না। ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে যুবকদের মুখের ভাষা, চোখের ভাষা বুঝতে হবে। যদি বুঝতে পেরে সামনে আগাতে পারে তাহলে জাতির অগ্রগতিতে যুবকরা সব সময় প্রস্তুত থাকবে। অনুষ্ঠানে শহীদ মুগ্ধ এবং আবু সাঈদের ওপর নির্মিত দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সম্মাননাও প্রদান করা হয়। শহীদ পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, আমাদের সন্তানদের হত্যার বিচার আজও হয়নি। বহু খুনি আজও ক্ষমতার ভিতরে ঘাপটি মেরে আছে। এক বছর পার হলেও এখনো একটি মামলারও বিচার হয়নি, এমনকি কোনো মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, গণঅধিকার পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান, এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু, শহীদ মীর মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান, আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ ও শহীদ নাহিদের মা। এ ছাড়া জামায়াতের ঢাকা মহানগরের উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, উত্তরের সেক্রেটারি ড. মু. রেজাউল করিম ও মুফতি হারুন ইজহার, কর্নেল হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক, লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে জুলাই নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হয়।