জুলাই ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছিল দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো।
কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে তারা। জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের বেকসুর খালাস পাওয়ার পর বর্তমানে মারমুখী অবস্থানে ছাত্রদল, শিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ও বাম সংগঠনগুলো। সর্বশেষ গতকাল চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।
জানা যায়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, ছাত্র ফেডারেশন,
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র অধিকার পরিষদের মতো ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করে আসছিল। কিন্তু এ টি এম আজহারুল ইসলামের বেকসুর খালাস নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পরপরই গত মঙ্গলবার বিকালে বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে জড়ো হয়। সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কলাভবন, আইবিএ হয়ে শাহবাগ প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যে পৌঁছায় এবং সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ছাত্রজোটের মিছিলে ছাত্রদল নেতা-কর্মীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়।
এদিকে এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট মিছিল বের করলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শাহবাগবিরোধী ঐক্যজোটের। বিক্ষোভ মিছিলে হামলার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে একে অন্যকে দায়ী করে ‘শাহবাগবিরোধী ঐক্যজোট’ ও ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট’। শাহবাগবিরোধীদের দাবি, উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হামলা করেছেন বাম ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। হামলার দায় শিবিরকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বুধবার সন্ধ্যায় টিএসসি থেকে শুরু হয় বামদের মশাল মিছিল। ছাত্রজোট সরাসরি জামায়াত ও শিবিরকে নিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করে। তবে মিছিলটি হলপাড়ায় পৌঁছালে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিজয় একাত্তর, মুহসীন ও এফআর হল থেকে ‘ভুয়া ভুয়া’ এবং ‘শাহবাগী, শাহবাগী’ স্লোগান দিতে শুরু করেন কিছু শিক্ষার্থী। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বামপন্থি সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা আরও জোরালো স্লোগান দিতে থাকেন। বাংলাদেশ ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ ও সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান এক বিবৃতিতে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সবার যে কোনো বিষয়ে বিক্ষোভ করার কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে বামপন্থিদের এই বিক্ষোভ থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে পুরোনো, পতিত ফ্যাসিবাদের স্লোগান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, শিবির ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের ছায়াতলে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সুপ্তাবস্থায় ছিল। ’২৪-এর গণ অভ্যুত্থানের পর তারা এখন প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু তারা গুজব, মিথ্যাচার আর সহিংসতার অপরাজনীতি করে ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ বিনষ্ট করছে। এ ধরণের সহিংস আচরণ পরিহার করে ভিন্নমতের প্রতি উদার ও সহনশীল আচরণ দেখাতে না পারলে তাদেরও ছাত্রলীগের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, জুলাইকে কেন্দ্র করে শিবিরের অনেক ছায়াসংগঠন গড়ে উঠেছে যেগুলো ক্যাম্পাসে তেমন প্রাসঙ্গিক নয় কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদই শিবিরকে ক্যাম্পাসগুলোতে সুযোগ করে দিয়েছে। বাকি বামপন্থি বা মধ্যপন্থি সংগঠনগুলো শিবিরকে সুযোগ দিতে আগ্রহী না। চব্বিশকে ব্যবহার করে একাত্তরকে খারিজ করতে চাচ্ছে। যারা একাত্তরকে খারিজ করতে চায় তাদের সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব নয়। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এর জন্য দায়ী শিবির। যারা এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করছে তাদের প্রতিহত করতে হবে এবং এই প্রতিহত রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মুখ্য সংগঠক তাহমীদ আল মুদ্দাসিসর চৌধুরী বলেন, এখানে মূলত সবগুলো পক্ষই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। ক্যাম্পাসগুলোতে সহিংসতার ঘটনা বন্ধ করা ও সহাবস্থান বজায় রাখার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত, দ্রুততম সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংগঠনগুলোর যে বসার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তা এই ৯ মাস পর দেখা যাচ্ছে না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।