হাওর ও জলাভূমি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বন্যাব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হলেও অনেকটা ঘুমিয়ে ২৫ বছর পার করে দিয়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ রয়েছে, এ দীর্ঘ সময়ে লক্ষ্য অর্জনে সমীক্ষা পরিচালনা ছাড়া মাঠ পর্যায়ে কোনো কাজ করেনি তারা। অধিদপ্তরের চোখের সামনেই অপরিকল্পিতভাবে হাওরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রাস্তা, রিসোর্টসহ সরকারি-বেসরকারি নানান অবকাঠামো। তারা বাধাও দিতে পারেনি। এতে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে হাওর। ফলে প্রতি বছর একের পর এক বন্যায় তছনছ হচ্ছে এ অঞ্চলের জনজীবন। জানা যায়, পলি জমে হাওর ভরাট হয়ে যাওয়ায় উজানের পানি দ্রুত ভাটিতে নেমে যেতে না পারায় গত বছরের মে, জুন, জুলাইয়ে তিন দফায় বন্যার কবলে পড়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। আর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য দায়ী করা হয় হাওরাঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সড়ক ও স্থাপনাকে। স্থানীয় সরকার প্রশাসনের স্থানীয় সূত্র জানান, অধিদপ্তরকে না জানিয়েই সরকারের বিভিন্ন দপ্তর হাওরে নানান প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা হাওর মহাপরিকল্পনার (২০১২-৩২ সাল মেয়াদি) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাওর এলাকায় চলমান ১১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে ১২টি মহাপরিকল্পনাবহির্ভূত। এ পরিস্থিতি সামলাতে হাওর অধিদপ্তর প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও তা গুরুত্ব পায়নি।
এ সুযোগে স্থানীয় রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা হাওরে রাস্তা, রিসোর্টসহ গড়ে তুলছেন নানান স্থাপনা। ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’। ২০১৬ সালে একে অধিদপ্তর ঘোষণা করা হয়। এ সময়ে কাজের মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে পাঁচটি সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তিনটি সমীক্ষা প্রকল্প চলমান আছে। তবে কোনো মন্ত্রণালয় গুরুত্ব না দেওয়ায় এসব সমীক্ষা তেমন কাজে আসে না। অনুসন্ধানে জানা যায়, কাগজে-কলমে এ অধিদপ্তরের কাঁধে বিশাল দায়িত্ব থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি কার্যত চলছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ধার করা জনবল দিয়ে। নিয়োগ বিধিমালায় হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের জন্য ১১৮ জনের অনুমোদিত জনবল থাকলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। সাতজন কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে এসে দায়িত্ব পালন করছেন। স্থায়ী কর্মচারী আছেন ২৯ জন। তাঁদের মধ্যে তিনজন করে দায়িত্ব পালন করছেন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ কার্যালয়ে। নেত্রকোনা কার্যালয়টি এখনো প্রস্তুত হয়নি। নিয়মিত অফিস খোলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আর বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ ছাড়া এদের তেমন কোনো কাজ নেই। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে এটা বোধহয় বিশ্বের সবচেয়ে ছোট ও অবহেলিত অধিদপ্তর, যেখানে কর্মকর্তাদের কেউই অধিদপ্তরের নন। তাঁরা কিছুদিনের জন্য আসেন, আবার চলে যান। তাই হাওর নিয়ে ভাবার তাগিদও তাঁদের মধ্যে থাকে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর পান্থপথসংলগ্ন পানিভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত হাওর অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মহাপরিচালককে বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই দিনই বদলি হয়ে যান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান। যাওয়ার আগে তিনি মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে না পারার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যানুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে তিনটি সমীক্ষা চলমান আছে। আরও তিনটি প্রকল্প আসছে। আশা করি পিএসসি দুই-তিন মাসের মধ্যে ২২ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। আমরাও ১৬ জন কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। জুলাই-আগস্টে হতে পারে। আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠিয়েছি। স্থায়ী জনবল বাড়লে অধিদপ্তর গতিশীল হবে।’