বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বকীয় নির্মাণযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। তখন নানা সীমাবদ্ধতার কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ অতটা সহজ ছিল না। তারপরও কিছু সিনেপ্রেমী ব্যক্তিত্বের অদম্য ইচ্ছাশক্তির সুবাদেই একসময় সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বিশ্বদরবারে নাম লেখায়। এ বিষয়ে কিছু শুরুর গল্প তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
প্রথম হেলিকপ্টার ব্যবহার :
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কাব্যনাট্য অবলম্বনে নির্মিত ‘বেদের মেয়ে’ ছবির চিত্রায়ণের জন্য বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে প্রথম ব্যবহার হয় হেলিকপ্টার। তখনকার সময় যা ছিল অকল্পনীয়। কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যনাট্য অবলম্বনে নুরুল হক বাচ্চুর ‘বেদের মেয়ে’ ছবির মহরত ও শুটিং হয় ১৯৬৮ সালে, ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। ‘বেদের মেয়ে’ ছবির আউটডোর শুটিংয়ে টপ শট নেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার হয়েছিল। এটাই এ দেশের ছবির শুটিংয়ে প্রথম হেলিকপ্টার ব্যবহার।
ফার্স্ট লেডি ‘সুমিতা দেবী’ :
যার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকার প্রচলন শুরু হয় তিনি সুমিতা দেবী, যাকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ফার্স্ট লেডি।’ ওই আমলে কোনো বাঙালি মুসলিম মেয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। সুমিতার প্রকৃত নাম হেনা ভট্টাচার্য। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নাম হয় নিলুফার বেগম। সুমিতা দেবী নামটি পরিচালক ফতেহ লোহানীর দেওয়া ‘আসিয়া’ ছবিতে।
এফডিসির প্রথম ছবি ‘আসিয়া’ :
এফডিসিতে শুটিং করা প্রথম ছবি ‘আসিয়া’। এটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ৪ নভেম্বর। ১৯৫৭ সালে গঠিত হয় এফডিসি। সে বছরেরই ২০ মে সেখানে প্রথম শুটিং হয় ‘আসিয়া’ ছবির। ছবিটির কাজ অবশ্য শুরু হয়েছিল আগেই। সরকারি প্রচার দপ্তরের উদ্যোগে। তবে প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে। নাম ছিল ‘লাইফ ইন ইস্ট পাকিস্তান’। এফডিসির শুরুতে একটা ছবি বানানোর কথা ভাবেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাজির আহমেদ। সেই ভাবনা থেকেই ‘লাইফ ইন ইস্ট পাকিস্তান’-এর পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। কাহিনি ও সংলাপ নাজির আহমেদ নিজেই লেখেন। চিত্রনাট্য তৈরি ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন ফতেহ লোহানী। পূর্বাণী চিত্রের ব্যানারে ছবিটির নাম রাখা হয় ছবির নায়িকা চরিত্রের নামে ‘আসিয়া’। ২০ মে ১৯৫৭ সালে এফডিসিতে ‘আসিয়া’র দৃশ্য ধারণ শুরু হয়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ৪ নভেম্বর।
রাজনৈতিক গল্পের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ :
রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে এ দেশে প্রথম চলচ্চিত্র জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে জহির রায়হান যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তা মাইলফলক হিসেবে রয়েছে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি অগণতান্ত্রিক সরকার এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে গড়িমসি করলে রাজপথে মিছিল হয়। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গণচেতনার প্রতিফলন হিসেবে এ চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ।
শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘সান অব পাকিস্তান’ :
ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ (১৯৬৬)ই এ দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র এটি। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাক ছবি : দ্য লাস্ট কিস
১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছিল ঢাকার প্রথম ছবি। এটি ছিল নির্বাক ছবি। ছবিটি পরিচালনা করেন অম্বুজ গুপ্ত। এ ছবির দৃশ্য ধারণ শুরু হয় ১৯২৯ সালে। ১২ রিলের এ নির্বাক ছবিটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ১২ হাজার টাকা। ১৯৩১ সালে এটি মুক্তি পায় ঢাকার তৎকালীন মুকুল সিনেমা হলে। এ সিনেমা হলে ছবিটি প্রায় এক মাস চলেছিল। ছবিটির একটি মাত্র প্রিন্ট তৈরি হয়। ছবির নায়ক ছিলেন খাজা আজমল আর নায়িকা লোলিটা ও চারুবালা। ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিল ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি।
নির্মাতা : অম্বুজ গুপ্ত
ঢাকাই ছবির প্রথম নির্মাতা ছিলেন অম্বুজ গুপ্ত। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘সুকুমারী’ ও পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য লাস্ট কিস’- এর নির্মাতা ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়ি ছিল ঢাকার দক্ষিণ বিক্রমপুরের মগর গ্রামে। শৈশব থেকেই ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন এবং যৌবনে ঢাকার একজন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও নাট্যনির্মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। খেলা ও নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সূত্রেই নবাববাড়ির সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি পরিচালনা করেন ‘সুকুমারী’ ও ‘দ্য লাস্ট কিস’।
নায়ক : খাজা আজমল
ঢাকাই ছবির প্রথম নায়ক ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান খাজা আজমল। ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। বেতারের অনেক নাটকেও অংশ নেন খাজা আজমল। একসময় অন্য নবাবদের সঙ্গে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
নায়িকা : লোলিটা
ঢাকাই ছবির প্রথম নায়িকা ছিলেন লোলিটা। তাঁর আসল নাম বুড়ি। ছবিতে তখন কোনো ভদ্রঘরের মেয়েকে অভিনয়ের জন্য পাওয়া যেত না বলে বাদামতলীর পতিতালয় থেকে বুড়িকে ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছবির নায়িকা হিসেবে আনা হয়। নাম দেওয়া হয় লোলিটা। তাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর। লাস্ট কিস ছবির কাজ শেষ হওয়ার পর লোলিটা আবার তাঁর পূর্ব পেশায় ফিরে যান।
সবাক ছবি : মুখ ও মুখোশ
ঢাকার প্রথম সবাক ছবি হলো- ‘মুখ ও মুখোশ’। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করেন আবদুল জব্বার খান। এর কাহিনিও লেখেন তিনি। ১৯৫৪ সালে এ ছবির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার রূপমহল এবং চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে এটি মুক্তি পায়। এতে অভিনয় করেন আবদুল জব্বার, পূর্ণিমা সেন, জহরত আরা, পিয়ারী বেগম, আমিনুল হক, সাইফুদ্দিন, গওহর জামিল, ইনাম আহমেদ প্রমুখ।
সিনেমা হল : পিকচার হাউস [শাবিস্তান]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আরমেনিয়া স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম সিনেমা হল পিকচার হাউস। ১৯৫৬ সালে এ সিনেমা হলের মালিক হন মো. মোস্তফা। তিনি এর নাম বদলে রাখেন শাবিস্তান। ঢাকার প্রথম নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয় এ সিনেমা হলে। হলিউডের গ্রেটা গার্বো অভিনীত একটি ছবি এখানে প্রথম প্রদর্শিত হয়।
সিনেমাস্কোপ ছবি : বাহানা
ঢাকার প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি হলো ‘বাহানা’। ১৯৬৫ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। উর্দু এ ছবিটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এতে অভিনয় করেন রহমান, কবরী প্রমুখ। রঙিন এ ছবিটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
রঙিন ছবি : বাদশা
স্বাধীন দেশে প্রথম রঙিন ছবি নির্মাণ হয় ১৯৭৫ সালে। ছবির শিরোনাম- ‘বাদশা’। আকবর কবির পিন্টু নির্মাণ করেন তারকাবহুল এ রঙিন ছবিটি। অভিনয় করেন খসরু, শাবানা, নূতন প্রমুখ। বাদশা দিয়েই শুরু হয় রঙিন ছবির যাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধের ছবি : ওরা ১১ জন
স্বাধীন দেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ হয় ১৯৭২ সালে। ‘ওরা ১১ জন’ শিরোনামের এ ছবিটি পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। প্রযোজনা করেন মাসুদ পারভেজ। এতে সত্যিকারের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়। ছবিটিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, খসরু, শাবানা, নূতন, সুমিতা দেবী প্রমুখ। ব্যাপক সফলতা পায় ছবিটি।