বর্তমান পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সব কিছুতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। তা বিভিন্ন শিল্পের ধারণা ও কাঠামোই পাল্টে দিচ্ছে, প্রযুক্তির কর্মদক্ষতা বাড়াচ্ছে এবং সময় ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রভাব থাকবে। এরই মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ও গবেষণার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। যদিও বিজ্ঞানীদের একাংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর মানুষের অতি নির্ভরতার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নির্ধারিত সীমা ও নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করলে তা মানব সমাজের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
মুসলিম বিশ্বের প্রযুক্তিবিদ ও সচেতন আলেমদের ধারণা, মুসলিম সমাজের শিক্ষা ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।
এর সুসংহত ব্যবহার শ্রেণিকক্ষের পাঠদান পদ্ধতিতেই শুধু পরিবর্তন আনবে না, বরং তা মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চায় যেসব সংস্কার ও ঐতিহ্য রয়েছে এবং যে সীমাবদ্ধতা ইসলামী জ্ঞানচর্চায় সযত্নে লালন করা হচ্ছে, তাও ভেঙে যেতে পারে। এতে ইসলামী জ্ঞানের জগৎ যেভাবে প্রসারিত হবে, সেভাবে তার ভাণ্ডারও এমন মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে হবে, যারা ইসলামী জ্ঞানের অপব্যবহারে আগ্রহী; বিশেষত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ইসলাম ও মুসলিম সমাজ সম্পর্কে অপপ্রচার, ভুল তথ্য ও প্রোপাগান্ডা নতুন মাত্রা লাভ করতে পারে। কেননা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা তথ্যজগতের ওপর নির্ভর করে থাকে।
মুসলিম প্রযুক্তিবিদদের দাবি, ইসলামী শিক্ষা ও মুসলিম সমাজের ওপর এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মন্দ প্রভাব থেকে বাঁচতে এখনই সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি; নতুবা অদূর ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মকে এর ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে না। এমনকি তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। প্রযুক্তি খাতের এমন একটি উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানের নাম EYouth। এটি মূল মিসরের একটি সামাজিক উদ্যোগ, যা তরুণদের ক্যারিয়ার উন্নয়ন ও শিক্ষায় সহায়তা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর জন্য ইন্টার্যাক্টিভ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে, যা তরুণ মুসলিমদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে।
শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, EYouth তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে টেকসই উন্নয়ন, আর্থিক শিক্ষা এবং সামাজিক সম্প্রীতির মতো জীবনমুখী বিষয়গুলো। প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা এআইচালিত প্রযুক্তিও যুক্ত করছে, যাতে মুসলিম তরুণরা বিষয়টি সহজে শিখতে পারে।
EYouth-এর নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা আবদুল লতিফ বলেন, আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা, দক্ষতা উন্নয়ন ও সার্বিক বিকাশে বিশ্বাস করি। আমাদের কোর্সগুলো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও ইচ্ছানুযায়ী শেখার সুযোগ দেয় এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করে। ডিজিটাল স্কিল, উদ্যোক্তা হওয়া এবং নেতৃত্ব দানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা তরুণদের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে প্রস্তুত করছি।
বর্তমানে EYouth মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও আরো কিছু অঞ্চলের ২১টি দেশে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবে নিজেদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চিন্তা করছে। এ ছাড়া তারা এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার অবহেলিত বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে, যেখানে ডিজিটাল শিক্ষা বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে EdTech Academy নামের একটি নতুন প্রতিষ্ঠান হয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাতা রেনাদ তুর্কি একজন গুগল-সার্টিফায়েড শিক্ষক। তিনি প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সঙ্গে AI-এর নৈতিক ব্যবহারের সমন্বয় ঘটাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটি এআইচালিত বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে যেমন—ব্যক্তিগত জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষকতা, মূল্যায়ন টুল, গল্প বলা, ডিজাইন ও ভিডিও প্রোডাকশনের জন্য জেনারেটিভ এআই। তারা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (LLMs) ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য কাস্টমাইজড শেখার পরিবেশ তৈরি করছে।
তুর্কি বলেন, একজন মুসলিম এআই প্রশিক্ষক হিসেবে আমি শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে এআই টুল ব্যবহার শেখাই। কিভাবে কোরআনিক তাফসির, আরবি শেখা বা ইসলামী ঐতিহাসিক পাঠ বিশ্লেষণে এআই সাহায্য করতে পারে সেটা দেখানো হয়। একই সঙ্গে এআইয়ের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন করি। আমরা এথিকাল এআই ফ্রেমওয়ার্ক এবং অ্যাডাপটিভ লার্নিং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছি, যাতে প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। EdTech Academy এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ৫০০-এরও বেশি শিক্ষক এবং এক হাজার ৫০০-এর বেশি শিক্ষার্থীকে এআইবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
কাতারের শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার বলেন, এআই সারা বিশ্বে শিক্ষার ধরন বদলে দিতে পারে। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে এর মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা আরো সহজ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সংস্কৃতিভিত্তিক হতে পারে। এআইচালিত প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীর নিজ গতিতে শেখার সুযোগ দেয়। ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষগুলো গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও পৌঁছাতে পারে, যেখানে স্কুলের সুযোগ সীমিত। অনুবাদ টুলস ভাষাগত বাধা দূর করে, যাতে বিশ্বজুড়ে জ্ঞান আরবি, উর্দু, মালয়সহ বিভিন্ন ভাষায় পৌঁছে দেওয়া যায়। এআই ইসলামিক শিক্ষাকেও উন্নত করতে পারে। যেমন—এআই টিউটররা অনারব ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের কোরআন শেখার সময় উচ্চারণ ও অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
ড. আবদুস সাত্তার বলেন, ‘চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে ইসলামী বিধান নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। এমনকি ইসলামিক ইতিহাসভিত্তিক ভার্চুয়াল রিয়ালিটি অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের জন্য সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা জীবন্ত করে তুলতে পারে। এ ছাড়া নৈতিক ও হালাল এআই তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে, যেখানে ইসলামী নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাইভেসি রক্ষা ও পক্ষপাতমুক্ত প্রযুক্তি নিশ্চিত করা হবে।’
কোনো সন্দেহ নেই, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামী দিনের ইসলামী শিক্ষার ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকার প্রভাব বিস্তার করবে। ইসলামী শিক্ষা ও তরুণ প্রজন্মকে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচাতে এখন থেকে সচেতনতামূলক উদ্যোগ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা গেলে এআই ইসলামী শিক্ষার জন্য সহায়ক মাধ্যম হতে পারে, নতুবা তার প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ।
সালাম গেটওয়ে অবলম্বনে
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন