ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে বিগত বহু মাস ধরে, কিন্তু সেই আলোচনার জট এখনও খোলেনি। এর মধ্যে চুক্তি ঘোষণার ‘ডেডলাইন’ পর্যন্ত একাধিকবার পেছোনো হয়েছে।
এই চুক্তির পথে প্রধান বাধা ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের কৃষিজাত, ডেইরি ও জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) প্রোডাক্টের জন্য আমেরিকার অধিকতর প্রবেশাধিকার (অ্যাকসেস) দাবি।
ভারত মনে করে এই অ্যাকসেস দিলে তাদের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই এই দাবি মানা হচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোমিও একাধিকবার বলেছেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হবে না।
এরপর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনাকে কেন্দ্র করে বিরোধ এবং চড়া হারে ভারতের ওপর ট্যারিফ বসানো সেই আলোচনাকে আরও জটিল করেছে-এবং প্রস্তাবিত চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
তবে এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ভারত তাদের বাজারে আমেরিকার নন-জিএম কর্ন (ভুট্টা) ও সয়মিল (সয়াবিনজাত পণ্য) অনেক বেশি পরিমাণে ঢুকতে দিতে রাজি। এই মুহূর্তে আমেরিকা থেকে নন-জিএম ভুট্টা আমদানির বার্ষিক কোটা মাত্র ৫ লাখ টন, ভারত সেটা অনেকটাই বাড়াতে পারে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে চীনেরও একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে-কারণ তারা আমেরিকা থেকে ভুট্টা কেনার পরিমাণ হালে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
২০২২ সালেও চীন যেখানে ৫২০ কোটি ডলার মূল্যের আমেরিকান কর্ন আমদানি করেছিল, ২০২৪ সালেই সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারে। ফলে আমেরিকাও এখন তাদের কর্নের জন্য নতুন বাজার ধরতে মরিয়া, আর ভারত তাদের সেই সুযোগটা দিতে পারে।
এদিকে, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পোল্ট্রি ফিড (মুরগি ইত্যাদির খাবার), ডেইরি ইনপুট (গবাদি পশুর খাদ্য) ও ইথানলের মতো বিকল্প জ্বালানির চাহিদাও হু হু করে বাড়ছে-সেটাকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেও ভারত আমেরিকান কর্নের জন্য দরজা অনেকটা অবারিত করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দ্য মিন্টকে জানিয়েছেন, আমেরিকা থেকে মানুষ ও গবাদি পশু উভয়ের খাবার উপযোগী নন-জিএম সয়মিল আমদানির অনুমদি দিতেও ভারত প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু আমেরিকার আলোচনাকারীদের আর একটি প্রধান দাবি-খুব উঁচু মানের চিজ-সহ মার্কিন ডেইরি প্রোডাক্টে ভারতের শুল্ক কমানো-সেটা নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দিল্লি ও ওয়াশিংটন ডিসি – দুই রাজধানী থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির একটা মোটামুটি রূপরেখা (ব্রড আউটলাইন) প্রায় তৈরি, কিন্তু জ্বালানি ও কৃষিখাতের বেশ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে দু'তরফ থেকে রাজনৈতিক ছাড়পত্র মিললে তবেই চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সম্ভব হবে।
দিল্লির গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ অজয় কুমার শ্রীবাস্তব মনে করেন, এই চুক্তি যদি সত্যিই অচিরে সম্পাদিত হয়, তাহলে সেখানেও চীনের একটা পরোক্ষ ভূমিকা থাকবে।
তিনি বলেন, চীন তাদের রেয়ার আর্থ রফতানির ওপর যেভাবে রাশ টেনে ধরছে এবং আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ যেভাবে দিনকে দিন খারাপ মোড় নিচ্ছে, তাতে আমেরিকা এখন তাদের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে এবং বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে নতুন নতুন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজছে। চুক্তি সম্পাদনের জন্য এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য অনুকূল হতে পারে।
এই পটভূমিতেই তার ধারণা-যাবতীয় দরকষাকষির শেষে আমেরিকা হয়তো ভারতকে ১৬-১৮ শতাংশ ট্যারিফের ব্র্যাকেটে ফেলতে চাইবে, ‘যেটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপানের ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি-কিন্তু ভিয়েতনামের ২০ শতাংশের চেয়ে কম!’
ভারতের রফতানি পণ্যের পর ট্রাম্প প্রশাসন যে ৫০% চড়া হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তার অর্ধেকটাই রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রুড কেনার জন্য ‘পেনাল্টি’ বা জরিমানা হিসেবে। অন্তত ঘোষিত কারণ এটাই।
এই ৫০ শতাংশের মধ্যে বাকি ২৫ শতাংশ হলো রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা ট্যারিফ-যা মার্কিন পণ্যের ওপর ভারতের বসানো শুল্কর পাল্টা পদক্ষেপ।
এখন সত্যিই যদি এই ৫০ শতাংশ ট্যারিফতে ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে তেল কেনার কারণে আরোপিত ২৫ শতাংশ পেনাল্টির পুরোটাই প্রত্যাহার করতে হবে-আর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফও অনেকটাই কমাতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে বা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েই কেবল ভারত এই সুবিধা আদায় করতে পারে।
সূত্র : বিবিসি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত