একসময় তিনি ছিলেন ভারতের উদ্ভাবনী শক্তির প্রতীক। বলিউড ব্লকবাস্টার থ্রি ইডিয়টসের প্রেরণাও তিনি। শিক্ষাক্ষেত্রে তাকে ধরা হতো এক মহান সংস্কারক। সেই সোনম ওয়াংচুক এখন লাদাখের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যাকে এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেখছে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আরব বসন্তের মতো বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করার গুরুতর অভিযোগ এনেছে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বিভক্ত করে বিশেষ মর্যাদা (আর্টিকেল ৩৭০) রদ করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সেসময় লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার সিদ্ধান্তে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন সোনম ওয়াংচুক। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক্স (তৎকালীন টুইটার)-এ লিখেছিলেন, লাদাখের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
কিন্তু লাদাখের জনগণের সেই আনন্দ দ্রুতই হতাশায় পরিণত হয়। রাজ্যের মর্যাদা হারানোর পর লাদাখকে স্থানীয় আইনসভা ছাড়া একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। যেখানে জম্মু ও কাশ্মীর একটি আইনসভাসহ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকে। এর অর্থ হলো লাদাখের জনগণের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে কোনো স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ রইল না। এই গণতান্ত্রিক অধিকারের অভাবই ধীরে ধীরে লাদাখকে রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন হতাশ সোনম ওয়াংচুক।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর, লাদাখের রাজধানী লেহ-তে সহিংস বিক্ষোভের দু'দিন পর সোনম ওয়াংচুককে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দূরে রাজস্থানের যোধপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে সরকার উৎখাত ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের আগে, সোনম ওয়াংচুক লাদাখের জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে শান্তিপূর্ণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। এই ষষ্ঠ তফসিল আদিবাসী-প্রধান অঞ্চলগুলিকে স্বশাসিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ার অধিকার দেয়, যা লাদাখের ৯০ শতাংশেরও বেশি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি।
কিন্তু, অনশনের ১৫তম দিনে একদল তরুণ বিক্ষোভকারী দলছুট হয়ে লেহতে বিজেপি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে একজন সাবেক সেনাসহ চারজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। আরও অনেকে আহত হন। এরপরই প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে আন্দোলনকারীসহ ৮০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় সোনম ওয়াংচুককে। ফলে তাঁকে বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটক রাখার সুযোগ পায় কেন্ত্রীয় সরকার। তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো সুপ্রিম কোর্টে স্বামীর আটককে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই গ্রেফতার আসলে তাঁকে চুপ রাখার জন্য। কেন্দ্রীয় সরকার আসলে লাদাখের আন্দোলনকে দুর্বল করতে চায়।
সরকার এখন সেই সোনম ওয়াংচুককেই রাষ্ট্রদ্রোহী বলছে, যিনি একসময় ভারত সরকারের প্রচারণার মুখ ছিলেন। লাদাখ পুলিশ প্রধান এসডি সিং জামওয়াল দাবি করেছেন, সোনম ওয়াংচুকের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। এক পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মীর গ্রেফতারের পর তার কাছে নাকি ওয়াংচুকের প্রতিবাদের ভিডিও পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, ওয়াংচুকের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেছেন, তাঁর স্বামী জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে জাতিসংঘ ও ডন মিডিয়ার আয়োজিত একটি ইভেন্টে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। যেখানে তিনি উল্টো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর জলবায়ু উদ্যোগের প্রশংসাই করেছিলেন।
সোনম ওয়াংচুকের গ্রেফতারের পর লাদাখের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় বসছিল। তারা এখন ওয়াংচুকসহ সমস্ত আটককৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং গুলিতে নিহতদের ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত আলোচনা থেকে সরে এসেছে।
লাদাখের পরিবেশবিদ ও সমাজকর্মীর এমন পরিণতিতে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, কঠোর দমন-পীড়নের মাধ্যমে লাদাখকেও যেন কাশ্মীরের মতো সময় বোমা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। লাদাখের জনগণ এখন প্রশ্ন তুলছেন, তাদের নেতার অপরাধ কী? তিনি কি শুধু গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক অধিকার চেয়েছিলেন?
সূত্র: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল