বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলে অস্থিরতা চলছে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলে সয়াবিনের রপ্তানি মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। ইউক্রেনে বেড়েছে সূর্যমুখী তেলের দাম। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতেও পাম তেলের দাম বাড়তি। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের রপ্তানি মূল্যের এ অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। এ অবস্থায় ভোজ্য তেল উৎপাদন ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে গতকাল বৈঠকও হয়েছে। তবে মূল্য নিয়ে মতৈক্য না হওয়ায় সে বৈঠক থেকেও দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানান, ভোজ্য তেল কোম্পানিগুলো যে দাম প্রস্তাব করেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেটি গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সে কারণে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। বৈঠকে ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, তাতে সয়াবিন ও পাম তেলের বিক্রয়মূল্য ২ থেকে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো যেতে পারে। তবে দেশের ভোজ্য তেল উৎপাদন ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর দাবি, রপ্তানি মূল্য বেশি পড়ায় স্থানীয়ভাবে ভোজ্য তেলের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত।
ভোজ্য তেল নিয়ে কী হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে : আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে গত আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে সয়াবিন তেলের রপ্তানি মূল্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী। চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে কিছুটা কমলেও ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনায় সয়াবিন তেলের দাম এখনো বাড়তি। এ ছাড়া কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে সূর্যমুখীর উৎপাদন কম হতে পারে, এমন পূর্বাভাসের কারণে ইউক্রেনীয় সূর্যমুখী তেলের দাম বাড়ছে। ওই অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য তেলের মজুত হ্রাস পাওয়ায় সরবরাহও কমছে। ইউরোপীয় অঞ্চলে রেপসিড তেলের রপ্তানি মূল্যও ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার পাম তেলের দাম ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বেড়েছে।
আমদানি কর বাড়িয়ে এনবিআরের প্রজ্ঞাপন : আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের রপ্তানি মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি যখন দেশের বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন সে অস্থিরতা আরও উসকে দিয়েছে এনবিআরের সিদ্ধান্ত। সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, পাম ও ভুট্টার তেল আমদানিতে ১ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করে সোমবার রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। এত দিন এ ক্ষেত্রে কোনো উৎসে কর ছিল না।
ভোজ্য তেল ও গম আমদানিতে সংকট : বাংলাদেশ প্রতিদিনের চট্টগ্রাম অফিস ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, দেশে হঠাৎ করেই কমেছে অতিপ্রয়োজনীয় তিন ভোগ্যপণ্য সয়াবিন, পাম তেল ও গম আমদানি। ব্যাংকিং খাতে নানান সীমাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি, গমের আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন এবং সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়হীনতাতেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে তৈরি হতে পারে এ তিন অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সংকট।
চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা জানান, দুই মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম। জুনে প্রতি টন সয়াবিন ১ হাজার ডলারে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ১ হাজার ২০০ ডলার। এমন অবস্থায় সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করে না দিলে গুনতে হবে লোকসান, এমন শঙ্কা ব্যবসায়ীদের। তাই ক্ষতি এড়াতে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একইভাবে চলতি অর্থবছরে কমেছে গমের এলসি এবং আমদানি। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে এলসি খোলার হার চাহিদা অনুযায়ী বৃদ্ধি করা না গেলে রোজার আগে বড় সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা। দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ বাজার খাতুনগঞ্জের ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের আইন সম্পাদক, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘এখনো ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশিত এলসি খুলতে পারছেন না। কিছু কিছু ব্যাংক এলসি মার্জিন বৃদ্ধি করেছে এবং ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট রয়েছে। এসব কারণে এলসি কমেছে। সরকার এলসি বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিলে ভোজ্য তেল, গমসহ নানান পণ্যের সংকট তৈরি হবে।’
আমদানিকারকরা জানান, প্রতি বছর দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। চাহিদা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানির বিপরীতে এলসি খোলার প্রয়োজন ছিল অন্তত সাড়ে ৪ লাখ টন। কিন্তু এ সময়ে আমদানিকারকরা এলসি খুলেছেন মাত্র ৩ লাখ টন। দেশে পাম অয়েল সাধারণত পরিশোধিত অবস্থায় আনা হয়। সয়াবিন তেল দেশে এনে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। এ প্রক্রিয়া করতে দুই-আড়াই মাস লেগে যায়। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিকারকদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তেলের দাম নির্ধারণ করে না দিলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন বলে তাঁদের আশঙ্কা। আস্থার সংকটের কারণেই মূলত ভোজ্য তেল আমদানির এলসি খোলার হার গত দুই মাসে অনেক কমে গেছে। আমদানি কমেছে দেশের খাদ্যের অন্যতম জোগান গমেরও। দেশে প্রতি বছর গমের চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এর ৮৫ শতাংশই করতে হয় আমদানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৬ লাখ ১৩ হাজার টন গম শুল্কায়ন হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ৭ লাখ ৫২ হাজার টন। এতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে গমের আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশ। আমদানি হওয়া গমের প্রায় ৬৫ শতাংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে এ দুই দেশের সরবরাহব্যবস্থা পড়েছে বাধার মুখে’ যার প্রভাব পড়েছে গম আমদানিতে।