জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে এ উদ্যোগ নিয়েছে তারা। পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবে দলগুলো। রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নির্ধারণ করে আগামী কয়েক দিন এ ধরনের বৈঠক করবেন তারা।
এর আগে দলগুলোকে ঐকমত্যে নিতে ব্যর্থ হয় কমিশন। একই সঙ্গে সরকারের বাড়ানো নির্ধারিত সময়ও শেষ হয়ে যায়। পরে রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে দলগুলো কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়েছে সরকার।
কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে দূরত্ব। ঐকমত্যে পৌঁছাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এখন শেষ চেষ্টা হিসেবে দলগুলো নিজেদের মধ্যে ওইসব ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায়। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঐক্যের বিকল্প নেই এমন ধারণাকে সামনে রেখে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দলগুলোর প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ থেকে দেশকে রক্ষা করেছে ছাত্র-জনতা। এখন তাদের মূল্যায়নের সময় এসেছে। আমরা যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে না পারি তাহলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। তাই এবার নিজেদের মধ্যে সংলাপ হবে অনানুষ্ঠানিক। এ পথ অনুসরণ করে যদি ঐক্য হয় তাহলে তা কমিশনকে জানানো হবে। তারা ঐক্যের বিষয়টি সমন্বয় করবেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত। কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে মেয়াদ বাড়াতে আবেদন জানাই। অন্য দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক ইস্যুতে দূরত্ব ও বিভেদ কমাতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টি, গণতন্ত্র মঞ্চ ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করতে চাই। আমাদের বৈঠকের ফলাফল পরে কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে।
জাবেদ রাসিন বলেন, সংস্কার ইস্যুগুলোর ওপর আমাদের অবস্থানের কথা দলগুলোকে জানাব। তাদেরও বক্তব্য শুনব। তারপর নিজেরা একটা সিদ্ধান্ত নেব। আশা করি, আমরা কেউই কট্রর অবস্থানে থাকব না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অবশ্যই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আমাদের রয়েছে।
এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের জন্য ৩০টি রাজনৈতিক দলকে দুজন প্রতিনিধির নাম পাঠানোর অনুরোধ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু অনেক দল সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে ৩০টি দলের মধ্যে ১৭টি রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিনিধির নাম পাঠায়। এ তালিকায় রয়েছে-বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমজনতার দল, ইসলামী ঐক্যজোট, গণসংহতি আন্দোলন, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। (জেএসডি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)।
নাম না পাঠানো দলগুলো যুক্তি দিয়ে বলেছে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদের কপি পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে নোট অব ডিসেন্ট, আংশিক একমত, মতামত দেয়নি-এসব বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এসব থাকা বিষয়গুলোকে তো ঐকমত্য বলা যায় না। তাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য নাম পাঠানো হয়নি। দলগুলোর নেতারা জানান, এখন তো পরিস্থিতি পাল্টেছে। কমিশনের মেয়াদ বেড়েছে। আরও আলোচনা হবে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখি। দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। মূল ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য হলে ও আদর্শিক বিষয়গুলো ঠিক থাকলে সনদ স্বাক্ষরের জন্য নাম পাঠানো হবে।
এর আগে রবিবার প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংলাপে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হলেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। সংলাপে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবারো গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আগামী সংসদের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবে অনড় রয়েছে। কমিশন আগামীকাল (বুধবার) আবারো সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, জুলাই সনদ প্রণয়নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে। ছয় মাস মেয়াদ শেষে কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। গতকাল ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় বাড়ানো কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়।