জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি আশুলিয়া থানার সাবেক এসআই শেখ আবজালুল হকের অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন শর্ত সাপেক্ষে মঞ্জুর করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শর্ত হচ্ছে, তাকে পূর্ণাঙ্গ সত্য উন্মোচন করতে হবে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দেন। এর আগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল আশুলিয়ার মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে আট আসামি গ্রেপ্তার রয়েছেন। তাদের গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। অভিযোগ গঠনের সময় এই আসামিদের মধ্যে শেখ আবজালুল হক ট্রাইব্যুনালে দোষ স্বীকার অ্যাপ্রুভার হওয়ার আর্জি জানান। তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমি দোষ স্বীকার করছি। একই সঙ্গে অ্যাপ্রুভার হয়ে পূর্ণাঙ্গ সত্য উন্মোচন করতে চাই এবং ক্ষমা চাই। এ সময় ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, এ মামলার সব আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হলো। এর মধ্যে একজন আসামি আবজালুল হক অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। এ আসামি বলেছেন, তিনি অ্যাপ্রুভার হতে চান। ট্রাইব্যুনাল তাকে অনুমতি দিচ্ছেন অ্যাপ্রুভার হওয়ার বিষয়ে আজ (গতকাল) বেলা ২টার মধ্যে আবেদন করার জন্য। এখন থেকে এ আসামির পুরো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পরে আসামি আবজালুল আবেদন করলে সেই আবেদন মঞ্জুর করা হয়। পরে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মামলার একজন অভিযুক্ত দোষ স্বীকার করে অ্যাপ্রুভার হওয়ার আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করেছেন। শর্তটি হচ্ছে, তিনি ঘটনার সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করবেন। এখন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি কারাগারে থাকবেন। উপযুক্ত সময়ে তার সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এক প্রশ্নে এই প্রসিকিউটর বলেন, তার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন জেল কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে তাকে আলাদা সেলে রাখা প্রয়োজন, তাহলে আলাদা সেলে রাখবে। সাধারণত এ ধরনের আসামিদের আলাদা সেলে রাখা হয়।
মামলার নথি অনুযায়ী রাজসাক্ষী হওয়া আসামি শেখ আবজালুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, গত বছর ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার তৎকালীন ওসি এ এফ এম সায়েদের নির্দেশনায় পুলিশ গুলি করে কমপক্ষে ২৯ জন ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে ও অনেককে গুরুতর আহত করে। এদের মধ্যে ৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পোড়ানোর সময় ১ জন জীবিত ছিল। ঘটনার সময় আসামি আবজালুল হক থানার মেইন গেটে সশস্ত্র অবস্থায় তার অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ডিউটিতে ছিলেন। সিডিআর পর্যালোচনায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। তার উপস্থিতিতে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে হত্যা করে। গুলি করে হত্যা করার পর লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আসামি শেখ আবজালুল হক এ মামলার ঘটনাস্থলে পুলিশ পিকআপ ভ্যানের কাছে অবস্থান করলেও তিনি সেই সময় পুলিশ পিকআপ ভ্যানে থাকা লাশে আগুন দিতে বাধা প্রদান করেননি বা জ¦লন্ত পিকআপ ভ্যানের আগুন নেভানোর কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেননি। তদন্তে গ্রেপ্তারকৃত আসামি এসআই শেখ আবজালুল হক সরাসরি উপস্থিত থেকে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ, অধীনস্থদের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ প্রদান, সহযোগিতা, সুযোগ তৈরি, সহায়তা এবং তিনি তার অধীনস্থদের মাধ্যমে নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড সংঘটন, লাশ পুড়িয়ে অন্যান্য অমানবিক আচরণ, উক্তরূপ অপরাধ সংঘটন হতে বিরত না রাখাসহ অন্যান্য উপায়ে ভূমিকা রাখেন।
চানখাঁরপুলে গুলিতে নিহত রাকিবের বাবা-ভাই সাক্ষ্য দিলেন ট্রাইব্যুনালে : জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে সংঘটিত ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহত রাকিব হাওলাদারের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ও ভাই রাহাত হাওলাদার। গতকাল বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তারা নিজেদের জবানবন্দি তুলে ধরেন। পরে তাদের জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। এ নিয়ে এই মামলায় আটজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
আন্দোলনে নিহত রাকিব হাওলাদারের পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার ছেলে ঢাকা চকবাজার থানাধীন নবাব বাগিচায় কাজল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করত। গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুর ১টার দিকে আমার ছেলে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে নাজিমুদ্দিন রোডে বুরহানউদ্দিন কলেজের সামনে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, এডিসি শাহ-আলম, রমনা জোনের এসি ইমরুল, শাহবাগ থানার ওসি আরশাদ হোসেনের নির্দেশ এবং উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ ও কনস্টেবল নাসিরুল আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।’ এ ছাড়া আন্দোলনে নিহত রাকিব হাওলাদারের বড় ভাই রাহাত হাওলাদার জবানবন্দি দেন। তিনি তার ভাইয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।