দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, কর্মসংস্থান বাড়েনি। বিনিয়োগেও রয়েছে স্থবিরতা। রিজার্ভ বাড়লেও কাঠামোগত চাপ রয়েছে। প্রকৃত অর্থে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখনো সীমিত।
গতকাল বেলা ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশ : কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছরের ওপর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। টিআইবি বলছে, ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি থাকলেও এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণখেলাপি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। এমনকি কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের তিন খাতেই লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে। ঢালাওভাবে আসামি করে মিথ্যা মামলা করা, গ্রেপ্তার ও মামলাবাণিজ্যের অভিযোগও উঠে এসেছে। এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা আদালতের ভিতরে হামলার শিকার হয়েছেন। আন্দোলনের পর বিভিন্ন থানায় হামলা, প্রতিশোধমূলক আটক ও জামিন না মঞ্জুরের ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। টিআইবির প্রতিবেদনে ছাত্র আন্দোলনের সময় হামলা ও হত্যায় ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা, শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু এবং আইন সংশোধনে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতির কথাও জানানো হয়। এ সময়ের মধ্যে ৫০টি আইন প্রণয়ন হলেও, শুধু নাম পরিবর্তনের জন্য ১৩টি অধ্যাদেশ জারি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। গুম-সংক্রান্ত রিপোর্ট ও যাচাইবাছাই শেষ হলেও বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের অভিযোগও রয়েছে পর্যবেক্ষণে। বিচার সংস্কার নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ শুরুতে না থাকার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ, পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক উল্লেখ করে টিআইবি জানায়, তবে মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করা আইনশৃঙ্খলার বড় ঘাটতি। মব তৈরি করে দাবি আদায়ের প্রবণতা ও সাফল্য দেখা দেয় যা সামাজিক অসহনশীলতা রোধে সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সুযোগ থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে- মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানুষ দীর্ঘসময় শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি গণ অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে বর্ণনা করেন। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কিংস পার্টি। কারণ এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যারা আছেন, তাদের মধ্যে দুজন সরকারে এখন আছেন। সে হিসেবে কিংস পার্টি। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক যাত্রা অশুভ ছিল। ওই দিন বিকাল থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলাবাণিজ্য শুরু করে এবং গত এক বছর ধরে তা আরও বেড়েছে। এমনকি দলের উচ্চপর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের জন্মলগ্ন থেকে একই রোল মডেল অনুসরণ করেছে। দখলবাজি, চাঁদাবাজির মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছে। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মোট ১২১ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। এসব রাজনৈতিক সহিংসতার ৯২ শতাংশের সঙ্গে বিএনপি, ২২ শতাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশের সঙ্গে জামায়াত এবং ১ শতাংশের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি জড়িত।