জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষোভ বাড়ছে। নানান বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন দলের নেতারা। বিশেষ করে সংলাপের অগ্রগতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রতা, সংলাপ বিলম্ব করার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পাশাপাশি কোন প্রক্রিয়ায় ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে একমত হতে যাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
দলগুলো কমিশনকে জানিয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশন কি শতভাগ ঐকমত্য চায়, নাকি সিঙ্গেল মেজরিটি চায় সে সিদ্ধান্ত আগে নিতে হবে। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়ে প্রতিটি বৈঠকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা হতাশা প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন, এভাবে ঐকমত্যের দিকে হাঁটলে কেয়ামত পর্যন্ত সময় লাগবে। কোনো কোনো ইস্যুতে কমিশনের নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে বলে জানান তাঁরা। পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে কমিশন দলগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ওই সংলাপে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি মতামতের ওপর তৈরি করতে চায় জাতীয় সনদ, যা ‘জুলাই সনদ’ হিসেবে এরই মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়গুলো থাকবে ওই সনদে। আর স্বাক্ষর নেওয়া হবে সব রাজনৈতিক দলের। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য নিয়ে। এ সময়ের মধ্যে সব রাজনৈতিক দল মৌলিক সংস্কার ইস্যুগুলো নিয়ে একমত হতে পারবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাই। তাঁদের বক্তব্য, একমতের মধ্যেও রয়েছে নানান ধরনের দ্বিমত।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে নির্বাহী বিভাগকে সর্বোচ্চ ‘নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা’ দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আপনারা এখানে সংস্কার নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু হতাশা কেউ ব্যক্ত করেন নাই। আমরা সবাই আশাবাদী মানুষ। আলোচনা চলছে। তার চেয়ে বেশি হয়তো খানাপিনা চলছে। সময় অনেক লাগছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা একটা জায়গায় ঐক্যে আসতে পারব।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। পাশাপাশি বৈঠকে যেসব রাজনৈতিক দলকে ডাকা হয়েছে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও দলের নিবন্ধন না থাকায়, কোন কারণে সংলাপে ডাকা হয়েছে সে প্রশ্নও তুলেছে এনসিপি এবং গণ অধিকার পরিষদ। এনসিপির সংলাপের রাজনৈতিক লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। এর আগে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোন পদ্ধতিতে জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ তৈরি হবে সেটা নিয়ে তারা ছয়টা প্রস্তাব দেন। সেগুলো ছিল নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে অথবা নির্বাচনের আগে গণভোট অথবা নির্বাচনের সময় গণভোট অথবা গণপরিষদ নির্বাচন বা আইনসভা নির্বাচন। আর একটা প্রস্তাব ছিল নির্বাচনের পরে সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার। ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে তাদের প্রস্তাবের ছয়টির মধ্যে তিনি এখন একটি প্রস্তাবের দিকে হেলে গেছেন, যে প্রস্তাবটি দিয়েছে বিএনপি।’ বাংলাদেশ এলডিপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে আমি হতাশ। তারা যে প্রক্রিয়ায় আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। একই বিষয় নিয়ে সংলাপে বারবার আলোচনা হচ্ছে, আবার একই ইস্যুতে একই দলের দুই, তিন জন বক্তব্য দিচ্ছেন। কমিশন চাইলে দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপ আরও কম সময়ের মধ্যে করতে পারে। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কী, তা স্পষ্ট নয় বলে মনে করি।’ তবে সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন শাহাদাত হোসেন সেলিম।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘একটি বিশেষ দলকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বা আলোচনাটা নিয়ে যাওয়ার একটা অভিযোগ প্রতীয়মান হচ্ছে। জামায়াতসহ কিছু কিছু দল এ অভিযোগ করছে। আমরাও বলেছি, এখানে সমস্ত রাজনৈতিক দলের বাইরেও গণ আন্দোলনে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানে সমস্ত পেশাজীবী সংগঠন, সাংবাদিকসহ তাদেরও মতামত নেওয়া দরকার। এখানে কোন দলকে কোন ক্রাইটেরিয়ায় সিলেক্ট করা হয়েছে সেটা জানি না। অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত দল নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক মৌলিক ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বেশির ভাগই এখনো ঝুলে রয়েছে।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘কমিশনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত কীভাবে করা যায়, নির্বাচনে কীভাবে টাকার খেলা বন্ধ করা যায়, পেশিশক্তিমুক্ত করা যায়, সাম্প্রদায়িক আঞ্চলিক প্রচারমুক্ত করা যায়, ভয়ের রাজত্বমুক্ত করা যায়, এমনকি প্রশাসনিক কারসাজিমুক্ত করা যায়-এ বিষয়ে উনারা বইয়ে কিছু কলাম লিখেছেন। কিন্তু জনগণের সামনে আলোচনায় আনছেন না। এটা একটা জরুরি কর্তব্য বলে মনে করি। এখনো আমরা সে আলোচনায় ঢুকতেই পারিনি।’
এ বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আলোচনার টেবিলে তর্কবিতর্ক, মতভেদ থাকতেই পারে। এসব স্বাভাবিক। তবে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জুলাইয়ের ৬ বা ৭ তারিখ পর্যন্ত সংলাপ চালিয়ে যাওয়া। এর মধ্যে আমরা অনেক বিষয়েই একমত হতে পারব বলে প্রত্যাশা করি। এরপর জুলাই সনদ তৈরির কাজে হাত দেওয়া হবে।’
এর আগে কমিশনের সংলাপ এক দিনের জন্য বয়কট করে জামায়াতে ইসলামী। সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকার প্রশ্ন তুলে তারা ওই বয়কট করে। আবার সংলাপে কথা কম বলতে দেওয়ার অভিযোগ তুলে কিছু সময়ের জন্য সংলাপ থেকে ওয়াকআউট করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরামের প্রতিনিধিরা। আবার সংলাপে আসনবিন্যাসে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে পেছনের সারিতে গিয়ে বসতেও দেখা গেছে।