জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করা হলেও দলটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছিল আইনে সুযোগ না থাকায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। তবে এবার সেই পথ খুলেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীর শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনের মুখে গত শনিবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের সংশোধনীতে অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। এরপর রাতেই এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশের গেজেট জারি করেছে সরকার। ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীর বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, সংশোধনীর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) মনে করে, এটি একটি যথোপযোগী উদ্যোগ। তিনি বলেন, যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনেও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বা সংগঠনের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার বিধান আছে। তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন বা ট্রাইব্যুনালে সংগঠন বা ব্যক্তির বিচার হলে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এই আইন বা প্রযোজ্য অন্যান্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ৩ ধারা উপধারা (২)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেছে, আদেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, উসকানি দিয়েছে, মদত দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহযোগিতা করেছে অথবা অন্য যে কোনোভাবে সেই অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে, তবে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা থাকবে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার, সংগঠনের নিষিদ্ধ ঘোষণার, এর নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত অথবা বাতিল করার এবং এর সম্পত্তি জব্দ করার।
সংশোধিত আইনে সংগঠন শব্দটির সংজ্ঞায়নও করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় সংগঠন বলতে যে কোনো রাজনৈতিক দলকেও বোঝাবে। পাশাপাশি দলের অধীনস্থ, সম্পর্কিত বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন অথবা গোষ্ঠীকে বোঝাবে। এর আগে, ২৩ মার্চ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো দলকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না, রাজনৈতিকভাবে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটা সম্ভব। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর এখনো পর্যন্ত সরকার সে ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত কদিন ধরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি ও জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির বিচারের জন্য আইনে প্রয়োজনীয় বিধান যোগ করার দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা।
প্রথমে বৃহস্পতিবার রাতে যমুনার সামনে অবস্থান নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে একদল বিক্ষোভকারী একই দাবিতে সমবেত হন। পরে এতে যোগ দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। পরে শুক্রবার জুমার পর তারা মিন্টো রোডের প্রবেশমুখে মঞ্চ বানিয়ে সেখানে সমাবেশ করেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সেখান থেকে হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ অবরোধের ঘোষণা দেন। পরে শনিবার শাহবাগে গণজমায়েত কর্মসূচি পালিত হয়। এর মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক হয় রাতে। সেখানে দলের বিচারে আইন সংশোধন, আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র ৩০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানান, ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে। পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।