দেশে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল এবং সিনেপ্লেক্স। কারণ একটাই, ‘ছবি নেই’। গত দুই মাসে বন্ধ হয়েছে বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’, মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের ‘পান্না সিনেমা হল’, যশোরের বাঘাইছড়ির ‘ময়ূরী সিনেমা হল’। আগামী মাসের মধ্যে চাহিদামতো ছবি না পেলে বন্ধ করে দেওয়া হবে কেরানীগঞ্জের ‘লায়ন সিনেমাস’ ও যশোরের ‘মণিহার’ সিনেমা হল। বিস্তারিত জানিয়েছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে
মির্জা খালেক, কর্ণধার, লায়ন সিনেমাস, ঢাকা
লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা আবদুল খালেক আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখার আর কোনো উপায় নেই। দেশে ছবি মুক্তি এখন ঈদকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বছরের বাকি মাসগুলোতে কোনো ছবি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা মানের অভাবে দর্শক দেখে না। দেশীয় ছবির অভাব যেহেতু রয়েছে তাই সেই অভাব পূরণে ভারতীয় ছবিও আমদানি করতে দিচ্ছে না সরকার। এ ছাড়া সিনেমা শিল্পের স্টেকহোল্ডারদের সরকার একবার ডেকে জানতে চায় না এই শিল্পটি কী অবস্থায় রয়েছে। আমরা সিনেমা হল মালিকরা একাধিকবার তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে এ নিয়ে সাক্ষাৎ করার আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি। তাই এখন আমার লায়ন সিনেমাসটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। বলতে গেলে দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। আমি ইতোমধ্যে এটি বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে আগামী দুই মাসের মতো লাগবে। তারপর বন্ধ হয়ে যাবে আমার স্বপ্নের ‘লায়ন সিনেমাস’। এরপরও বলব, সরকার যদি দেশের সিনেমা শিল্প বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমরা আবার নতুন উদ্যমে সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্স বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব।
গত ঈদের পর থেকে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা করে লস দিয়ে যাচ্ছি। আর কত টানা যাবে, আর টানতে পারব না। রাজধানী ঢাকার অদূরে সবচেয়ে আধুনিক ও মানসম্পন্ন সিনেমা হল বলা হয় লায়ন সিনেমাসকে, চারটি স্ক্রিন নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালে।
লোকসান গুনে কতদিন চালু রাখব
মিয়া আলাউদ্দিন, সি. কর্মকর্তা চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি
এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, মালিকরা সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্স বন্ধ করছেন বাধ্য হয়ে বাঁচার জন্য। আগে খোলা রাখতেন বাঁচার জন্য আর এখন বন্ধ করছেন বাঁচার জন্য। তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন দেশের সিনেমা শিল্পের অবস্থা কতটা নাজুক হয়ে পড়েছে। এ কর্মকর্তা বলেন, গত ২৬ আগস্ট সিনেমা হল মালিকরা তথ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জানিয়েছেন, সিনেমা হল চালু রাখার মতো পর্যাপ্ত ও মানসম্মত দেশীয় ছবি দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।
শুধু দুই ঈদে কিছু ছবি পাওয়া যায়। বছরের বাকি ১০ মাস ছবিশূন্য সিনেমা হল কীভাবে চালানো সম্ভব? এ অবস্থায় লোকসান গুনে আর কতদিন সিনেমা হল চালু রাখা যায়। এ অবস্থায় তথ্য সচিবকে আমরা জানিয়েছি, অচিরেই ভারতীয় ছবি আমদানির অনুমতি, আমদানির পর তাৎক্ষণিকভাবে সেন্সর করা এবং যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের নীতিমালা সহজ করা না হলে দেশে আর কোনো সিনেমা হল চালু রাখা সম্ভব নয়। তথ্য সচিব জানিয়েছিলেন, শিগগিরই তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এরপর বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
গত তিন মাসে ১০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছি
রুবেল, কর্ণধার মধুবন সিনেপ্লেক্স, বগুড়া
বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার রাকনুজ্জামান ইউনূস রুবেল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হল চালানোর মতো ছবি নেই। একসময় যেমন শুধু ঈদে বিটিভিতে প্রখ্যাত নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ‘জব্বার আলী’ নাটক প্রচার হতো ঠিক তেমনি এ দেশের ছবি হয়ে গেছে ঈদকেন্দ্রিক। ঈদ ছাড়া ছবি পাওয়া যায় না। দেশীয় ছবির অভাব পূরণ করতে ভারত থেকেও ছবি আমদানি করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার বলছে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। যদি ভালোই হয় তাহলে সেখান থেকে ছবি আনতে বাধা কোথায়। গত তিন মাসে ছবিশূন্য সিনেমা হল চালাতে গিয়ে ১০ লাখ টাকারও বেশি লোকসান গুনেছি। একটি সিনেমা হল চালাতে মাসে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ হয়। এ সরকার অথবা আগামী নির্বাচিত সরকার যদি সিনেমা শিল্পের সব সমস্যার সমাধান করে দেয় তাহলে আমরা অবশ্যই সিনেমা হল আবার চালু করব। আমরা সিনেমা হলকে এখন আর দুই ঈদের জন্য ‘মৌসুমি সিনেমা হল’ হিসেবে চালু রাখতে চাই না। ২০২১ সালে আধুনিকভাবে মধুবন ‘সিনেপ্লেক্স’ হিসেবে চালু করা হলেও ছবির অভাবে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ‘একেবারে বন্ধ’ করে দেওয়া হয়েছে এটি। মধুবন সিনেপ্লেক্সের আসন সংখ্যা ছিল ৩৩৬টি।
ব্যাক টু ব্যাক ছবি না থাকলে হল চালু রাখা যায় না
আসগর পান্না, কর্ণধার পান্না , সিনেমা হল, মুন্সিগঞ্জ
মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের পান্না সিনেমা হলের মালিক আসগর পান্না গত পরশু তার ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাস দিয়ে হলটি বন্ধের ঘোষণা দেন। তার দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘ছবির অভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুন্সিগঞ্জের পান্না সিনেমা হল বন্ধ করা হলো।’ সংস্কৃতির আদিভূমি হিসেবে পরিচিত বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জে কেবল টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেখানকার একমাত্র এই সিনেমা হলটি। আসগর হোসেন বলেন, ব্যাক টু ব্যাক ভালো সিনেমা না থাকলে দর্শক জমিয়ে রাখা যায় না। এ অবস্থার উত্তরণে তার পরামর্শ, দ্রুত উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানি, যৌথ প্রযোজনা নীতিমালার সহজীকরণ এবং সিনেমা সংস্কারে আমদানিকৃত দ্রব্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হলে আপাতত রক্ষা পাওয়া যাবে নয়তো অনেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাবে।
এভাবে তো লস দিয়ে হল খোলা রাখা যায় না
জিয়াউল ইসলাম, এমডি , মণিহার সিনেমা হল, যশোর
দেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল যশোরের ‘মণিহার’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম বলেছেন, ছবির খরায় এটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সিনেমা ব্যবসা এখন ঈদকেন্দ্রিক হয়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুই ঈদের সিনেমা দিয়ে টুকটাক চালালাম, ব্যবসা করলাম। ঈদের পর গত জুলাই মাস থেকে কোনো সিনেমা নেই। এভাবে তো লস দিয়ে দিয়ে হল খোলা রাখা যায় না। হতাশা প্রকাশ করে জিয়াউল ইসলাম বলেন, আমরা আর চালাতে পারছি না। কর্মচারীদের বেতন বাকি থাকছে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছি না। হল খোলা থাকলে একজনকে নিয়ে সিনেমা চালালে যেই বিল আসে, ১ হাজার লোক নিয়ে চালালেও সেই বিল আসে। যার কারণে এখন আমাদের বাধ্য হয়ে হল বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। জিয়াউল ইসলাম বলেন, দেশীয় নতুন ভালো ছবি বা ভারতীয় সিনেমা আমদানি করার আশ্বাস না পেলে সিনেমা হল চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। ১৯৮৩ সালে সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত ও দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘জনি’ সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় দেশের সব থেকে বড় যশোরের ‘মণিহার’ সিনেমা হলের। হলটিতে আসন ১ হাজার ২০০। গত বছর হলের পাশেই তৈরি করা হয় ৬৬ আসনের মণিহার মাল্টিপ্লেক্স।