জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নন্দিত অভিনেতা, লেখক ও নির্দেশক আবুল হায়াত। সাংস্কৃতিক বিনির্মাণে ষাট দশক থেকে বর্তমানের সেতুবন্ধনে তাঁর রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। নিজেকে ছড়িয়েছেন দুই হাতে; প্রতিটি ক্ষেত্রে দর্প নিয়ে ছুটে চলেছেন সমানতালে। এ দুরন্ত ছুটেচলায় কখন যে ৮১টি বসন্ত পার করে এসেছেন, তা মনে হয় তাঁর নিজেরও অজানা! এ দুরন্ত ছুটেচলা মানুষটি বছরে দুবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনে সিক্ত হন। তবে ৭ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর প্রকৃত জন্মদিন। বলা দরকার, এদিন তাঁর নাতনি শ্রীষারও জন্মদিন। গতকালের বিশেষ দিনটা কেটেছে তাঁর একটু অন্যভাবে। সকালে মাছরাঙার রাঙা সকাল অনুষ্ঠান শেষ করে চ্যানেল আইয়ের ‘তারকা কথনে’ অংশ নিয়েছেন। এরপর পরিবারের সবার সঙ্গে বাইরের একটি রেস্টুরেন্টে ডিনারে অংশ নিয়ে এ দিনটা একটু অন্যভাবে কাটিয়েছেন। প্রতিবারের মতো তাঁর চাওয়া, ‘প্রতিবারের মতো আমার সব দিনই প্রথম দিনের মতো। সব সময়ই কিছু করার চেষ্টা করি। ইচ্ছা রয়েছে, একটি বই লেখার। এক জীবনে অনেক কিছুই তো লেখা যায় না; অনেক কিছু বাদ পড়ে যায়। তাই আরও কিছু লিখতে চাই।’ এ নাট্যজন তাঁর শৈশব স্মৃতি ও বেড়ে ওঠার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘জন্মটা মুর্শিদাবাদে। তিন বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে আমি এসেছি। চট্টগ্রামের রেলওয়ে কলোনিতে আমার বেড়ে ওঠা। এ শেষ বয়সে এসে যে নস্টালজি আমাকে সব সময় তাড়া করে, স্মৃতিকাতর করে তার মধ্যে একটা হলো- রেলগাড়ি আর অন্যটি হলো সমুদ্র। আসলে চট্টগ্রাম শহরের নাম শুনলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। আমার প্রফেশনাল লাইফের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে গেলেও চট্টগ্রামকে আনতে হবে। কারণ বাবা রেলে চাকরি করতেন। রেলওয়ে ক্লাবে প্রতি মাসে একটা করে নাটক হতো। নাটকের প্রতি পাগল কিছু লোক ছিল রেলওয়েতে, তারা অভিনয় করত। বাবা যেহেতু সেক্রেটারি, তাই সব নাটকই আমি দেখতাম। নাটক হলেই বাবা নিয়ে যেতেন মাকে সঙ্গী করে। সঙ্গে আমি মায়ের হাত ধরে চলে যেতাম। ওই কারণে নাটকের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা ছিল এবং সেখানে অমলেন্দু বিশ্বাসের মতো একজন অভিনেতাকে চোখের সামনে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছি। তিনি হলেন আমার ইন্সেপেরেশন। পরবর্তীকালে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত যে আমি তার মতো হব।’ এরপর ফের বলতে লাগলেন, ‘‘১০ বছর বয়সেই অভিনয়ে আসা। বন্ধু জামালউদ্দিন, মিন্টু একই পাড়াতে থাকতাম। সেই বয়সে বাড়ির পাশে চৌকি দিয়ে, শাড়ি-চাদর তার দিয়ে ঝুলিয়ে স্টেজ বানিয়ে, বাড়ি থেকে লাইট কানেকশন নিয়ে এসে আমরা সবাই মিলে আমার মামার ডিরেকশনে ‘টিপু সুলতান’ নাটক করি। সেটিই আমার জীবনের প্রথম নাটক ছিল। পরে ক্লাস টেনে পড়ার সময় ‘কলির জ্বিন’ নামে একটি নাটক করলাম। একবার আমাদের পাড়াতে নাটক করলাম। আমাকে হিরোর চরিত্র দিল; ছোটবেলায় চেহারা নাকি সুন্দর ছিল! যদিও আমি লজ্জায় হিরোর পাট করলাম না, করলাম ছোট্ট একটি ভিলেনের (দুষ্ট লোক/কমেডিয়ান) পাট। সেই চরিত্র করেও তখন ফাটিয়ে দিলাম। এরপর থেকেই নাটকের প্রতি একটা নেশা ধরে গেল এবং একসময় মজাটা আরও বাড়তেই থাকল। ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। চলে এলাম ঢাকায়, বুয়েটে পড়তে। সেটা ’৬২-এর দিকের ঘটনা। এসে দেখলাম সেখানে ভালো ভালো কিছু নাটকের দল আছে। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে প্রথম নাটকে অভিনয় করলাম। সেই সময় ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তারপর তো নাটকের পোকা এমনভাবে মাথায় ঢুকে গেল! যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আমরা কজনা’-এর সঙ্গে যুক্ত হই। বুয়েট পাস করে ওয়াসার সরকারি চাকরিতে যুক্ত হলাম ১৯৬৮ সালের দিকে। এ সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদ নামে একটি সংগঠন ছিল। ওরা যেন কেমন করে আমাকে খুঁজে বের করল। ড. ইনামুল হকের মাধ্যমে আমাকে খুঁজে বের করেছিল। ইনাম সাহেব আমাদের বুয়েটের টিচার ছিলেন। আমার দুই বছরের বড়। ওই সময় সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’ নাটকে অভিনয় করি। এটি সে সময় ব্যান্ড করে দেওয়া হলেও মিলিটারির কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে মঞ্চায়ন করি। ওই যে ঢুকলাম। এরপর ’৬৮ সালের শেষ দিক থেকে ’৬৯, ৭০ ও ৭১-একটা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। আমরা শহীদ মিনারে, জহুরুল হক হলে, মুহসীন হলে, জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে নাটক দিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে গেলাম। ১৯৬৮ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ও করেছিলাম। মাঝে ১৯৭০ সালে নিজের পছন্দেই বিয়ে করি মাহফুজা খাতুন শিরিনকে।’’ হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর নাটকে কাজ করেছেন নাট্যজন আবুল হায়াত। ‘মিসির আলী’ এর মধ্যে একটি স্মরণীয় চরিত্র। করেছেন চলচ্চিত্র শঙ্খনীল, কারাগার ও আগুনের পরশমণি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘‘তাঁকে চিনি ’৮৪-৮৫ সাল থেকে। তখন তাঁর লেখা একটি নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, নাটকটির নাম ছিল- ‘প্রথম প্রহর’। অভিনয় দেখে তাঁর ভালো লেগেছিল বলেই যে নাটকই লিখত সেখানে আমার একটা চরিত্র থাকত। সেই স্ক্রিপ্টটার ওপরে লিখে দিত- এই চরিত্রটা হায়াত ভাইয়ের। কিন্তু একসময় দেখলাম তাঁর চারপাশে প্রচুর চাটুকার জমে গেছে। এরপর আস্তে আস্তে সরে এলাম। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ যখন নুহাশপল্লীতে গেল তখন ওইখানে আমার যাওয়া হয়নি। নৌকায় যেতে হতো। কয়েকবার আমাকে আসতে বলেছিল। আমি বলেছিলাম- হুমায়ূন আই অ্যাম সরি! আমি যেতে পারব না। তাঁর আরেকটা সমস্যা ছিল, শিডিউল ঠিক রাখতে পারত না। আমি তখন দারুণ ব্যস্ত। এসব কারণে এরপর তাঁর সঙ্গে তেমন করে কাজ করা হয়নি। দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আমি তাঁর এখনো ভক্ত। সে একজন মেধাবী লেখক; বাংলাদেশের নাটকের ধারা সে পাল্টে দিয়েছিল। মানুষের মনকে বোঝার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। লেখার মধ্যে ছিল সেই লেভেলের পরিমিতিবোধ।’’ ১৯৭২ সালে ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ অভিনয় করেন আবুল হায়াত। সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সিনেমাতেও ছিলেন সপ্রতিভ। প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহর প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এ বড় মির্জা চরিত্রে অভিনয় করে কেড়ে নেন দর্শক মুগ্ধতা। ১৯৭২ সালে হাসান ইমাম প্রস্তাব দিলেন, সিনেমায় অভিনয় করবেন কি না। ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনে তো রোমাঞ্চিত। তিনি এফডিসিতে ডাকলেন। মাথায় চুল লাগিয়ে মেকআপ দিয়ে টেস্ট করে ঋত্বিক ঘটকের সামনে নেওয়া হলে পরিচালক বললেন, ‘চুলটুল লাগব না। এমনিতেই তোমারে জমিদারের মতো লাগতেছে। তুমি এমনিতেই পাস।’
অভিনয়জীবনের শুরুর দিকেই ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নামে সুযোগ পাওয়া তাঁর জন্য অবিস্মরণীয় ঘটনা। তিনি বলছিলেন, ‘‘ভোর ৫টায় ঢাকা থেকে নিয়ে গেছে। আরিচা পর্যন্ত যেতে তখন তিনটা ফেরি ছিল। গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইলাম। সারা দিন ওয়েট করলাম। আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো, এ-ই হচ্ছে তোমার সিন। ওই হচ্ছে তোমার সিন। এসব করতে করতে সন্ধ্যাবেলায় ঋত্বিকদা বললেন, ‘আইজক্যা তো পারুম না। কাইলক্যা অইবো তোমারটা।’ আমার তো মাথায় হাত। সরকারি চাকরি করি। ছুটি নিয়ে গেছি। এক দিনের ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে আরেক দিন! অনেক হাতে-পায়ে ধরে বললাম, আমাকে মাফ করে দেন। পরে যেদিন হবে, সেদিন আর স্ক্রিপ্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সহকারী পরিচালকের সঙ্গে ঝগড়াটগড়া শেষে ঋত্বিকদা মাটিতে বসে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন।’’ সরকারি চাকরি, বেতন কম। বাবার মৃত্যুর পর সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন। নাটক করে তো আর তেমন আয়রোজগার হয় না। তাই সবার পরামর্শে ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর লিবিয়া যান আবুল হায়াত। এক মাস পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় পুরো পরিবার। তবে ঢাকার অভিনয়জীবন ছেড়ে যেতে একটুও মন সায় দেয়নি। লিবিয়ায় গিয়ে অভিনয় করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে। তিন বছর পর ঢাকায় ফিরে চাকরিতে যোগ দেন, কিন্তু আর্থিক টানাপোড়েন থেকেই যায়। সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেসরকারি চাকরি নেন, কিছুদিন পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। এ সময় তিন মাস ছিলেন লাওসে। ১৯৯৫ সালের দিকে বিটিভিতে প্যাকেজ যুগের শুরুর দিকেই ভিডিওমাধ্যমে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আবুল হায়াত। পুরোপুরিভাবে চাকরি ছেড়ে পেশা হিসেবে এ মাধ্যমকেই বেছে নেন।