মানবসমাজে ন্যায়-অন্যায়, জুলুম-অত্যাচার এবং সাহায্য-সহযোগিতা এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। সাধারণত মানুষ মনে করে, সাহায্য করতে হয় শুধু নিপীড়িত বা মজলুমকে। কিন্তু ইসলাম তার শিক্ষায় এক ভিন্ন ও গভীর দিকনির্দেশনা দিয়েছে। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মজলুমকেই নয়, বরং জালিমকেও সাহায্য করার শিক্ষা দিয়েছেন।
চলুন জেনে নেই সেই সাহায্যের ধরণ কীরূপ-
আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমার ভাইকে সাহায্য কর। সে জালিম হোক অথবা মজলুম হোক। এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসুল! মজলুম হলে তাকে সাহায্য করব তা তো বুঝলাম।
কিন্তু জালিম হলে তাকে কীভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন- তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখবে। আর এটাই হল তার সাহায্য। (বুখারি হাদিস : ৬৯৫২)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
হাদিসে বর্ণিত জালিমকে সাহায্যের অর্থ কোনোভাবেই তার জুলুমকে সমর্থন করা নয়, বরং জুলুম থেকে তাকে নিবৃত্ত করাই প্রকৃত সাহায্য। এই শিক্ষা ইসলামী নৈতিকতার এক অনন্য আলোচ্য বিষয়।
১. সাহায্যের প্রকৃত ধারণা
মানবসভ্যতায় সাধারণভাবে সাহায্যের অর্থ দাঁড়ায় বিপদে পড়া মানুষকে পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সাহায্যের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত। এখানে দেখা যাচ্ছে, শুধু মজলুম নয়, বরং জালিমকেও সাহায্য করতে হবে। পার্থক্য হলো— মজলুমকে সাহায্য করা মানে তার ওপর থেকে অত্যাচার দূর করা, তাকে শক্তি দেওয়া। আর জালিমকে সাহায্য করা মানে তার জুলুম বন্ধ করা, যাতে সে পাপের বোঝা না বাড়ায় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পায়।
২. জুলুম থেকে বিরত রাখা মানেই প্রকৃত মেহেরবানী
কোনো ব্যক্তি যখন অন্যের ওপর জুলুম করছে, তখন তাকে জুলুমে সহায়তা করা আসলে তার সর্বনাশে সাহায্য করা। কারণ জালিমের প্রতিটি জুলুম তার দুনিয়ার সম্পর্ক নষ্ট করে এবং আখিরাতে ভয়ংকর শাস্তির কারণ হয়। তাই যদি তাকে থামানো যায়, তবে আসলে তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচানোই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য।
৩. সামাজিক দায়িত্বের শিক্ষা
এই হাদিস আমাদের শেখায় যে সমাজে জালিম ও মজলুম—উভয়কেই মুসলমানের দায়িত্বের আওতায় নিতে হবে। জালিমকে তার জুলুম থেকে বিরত না করলে সমাজে অন্যায় বেড়ে যায়, অন্যদিকে মজলুমকে সাহায্য না করলে অবিচার টিকে থাকে। সুতরাং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য উভয়কেই সহায়তা করতে হবে, তবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে।
৪. নৈতিক ও আইনি দিক
ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত আচার-আচরণে নয়, বরং সামাজিক আইন ও ন্যায়বিচারে এ নীতি প্রযোজ্য করেছে। শরিয়াহ আইন, সালিস প্রক্রিয়া, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ—সবখানেই এই নীতির প্রতিফলন। একজন মানুষকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করা যেমন ইবাদত, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরাধ দমন করাও ইসলামের নির্দেশ।
৫. আধ্যাত্মিক শিক্ষা
এই হাদিসের আরেকটি গভীর তাৎপর্য হলো—মানুষের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা মানেই তার আখিরাত রক্ষা করা। তাই জালিমকে জুলুমে সহায়তা করা আসলে তার প্রতি বিদ্বেষ; আর জুলুম থেকে ফিরিয়ে আনা প্রকৃত ভালোবাসা ও মেহেরবানী।
হাদিসটি আমাদের শেখায় যে, সাহায্য মানে শুধু দুর্বলকে সমর্থন দেওয়া নয়, বরং অপরাধীকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় দমন উভয় দিক থেকেই এটি অপরিহার্য। তাই একজন প্রকৃত মুসলমান তার ভাইকে সাহায্য করবে—সে মজলুম হলে তাকে রক্ষা করে, আর জালিম হলে তাকে থামিয়ে। এভাবেই ইসলাম সাহায্যকে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার সাথে একীভূত করেছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম