বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ‘যত ভিউ, তত বাণিজ্য’- এটিই যেন এখনকার সময়ে টিকে থাকার মূলমন্ত্র। এখন শিল্পীর যোগ্যতার মানদণ্ড বিচার হচ্ছে সামাজিকমাধ্যম আর ইউটিউবে তার অভিনীত নাটক বা গাওয়া গানের ভিউ লাখ না কোটি। যেখানে জনপ্রিয়তা আর যোগ্যতার মাপকাঠি কেবল ভিউ। এটাই কি আসলে হওয়া উচিত? একজন অভিনয়শিল্পীর অভিনয় দক্ষতা কতখানি বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী আর সেই শিল্পীর কনটেন্ট কতটা সুনিপুণভাবে নির্মিত হয়েছে সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই এখন। এ সময়ের গান কিংবা বেশির ভাগ নাটক আলোচনায় এসেছে ভিউর বিবেচনায়। কত ঘণ্টায় কতসংখ্যক ভিউ হয়েছে, কে কার আগে মিলিয়নের ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছে তা নিয়েই সবার মাথাব্যথা। সর্বোপরি বাংলা গান আর নাটক যেন আটকে গেছে ভিউর গণ্ডিতে। আর ভিউ যত বেশি জনপ্রিয়তা তত সহজ এখন।
একটা সময় ক্যাসেট বা সিডি বিক্রির হিসাবে শিল্পীর জনপ্রিয়তা বিচার করতেন সংগীতপ্রেমীরা। যত বেশি বিক্রি, তত বেশি টিআরপি। প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শিল্পীকে যথাযোগ্য সম্মান দিত। তার সম্মানী হু হু করে বাড়ত। ঘুরে যেত শিল্পীর ভাগ্য। একই রকম চিত্র ছিল নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে। একসময় নাটক ও চরিত্রের নাম মানুষের মুখে মুখে থাকত। কোন কোন অভিনেতা ভালো অভিনয় করলেন আর কোন নির্মাতা গল্পটি কত ভালো উপস্থাপন করতে পারলেন, তা নিয়ে চলত আলোচনা। সেই জায়গা দখল করেছে এখন ভিউ। ভিউর গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে নাটকের গল্প, শিল্পী, নাম নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ভিউকে। ভালো অভিনয়শিল্পীরা কাজ পাচ্ছেন না তাদের ভিউ নেই বলে। অন্যদিকে যেসব শিল্পীর ভিউ আছে তাদের শিডিউল পাওয়া দুষ্কর। দুই-তিনজন ভিউখোর শিল্পী সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের পারিশ্রমিক। নাটক হয়ে যাচ্ছে সস্তা বিনোদন। যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যাপক অশ্লীলতা, নোংরামি আর কুরুচিপূর্ণ সংলাপ। যেহেতু নেগেটিভ জিনিস দ্রুত জনপ্রিয় হয়, তাই রাতারাতি ভাইরাল হচ্ছে সেসব সংলাপ আর শিল্পীরা। ফলে ভিউর পেছনে ছুটতে গিয়ে বাংলা নাটকের মান কমছে, হারাচ্ছে ঐতিহ্য। বাড়ছে রুচিহীন নাটকের সংখ্যা। ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে দিনদিন বাংলা নাটকের ঐতিহ্য বিলীনের দিকে। শিল্পীরাও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। একপক্ষ শিল্পকে পণ্য বানিয়ে অধিক বাণিজ্যের লোভে বস্তাপচা গান আর নাটক বানিয়ে পকেট ভারী করছে। এ সময়ের বেশির ভাগ সাংস্কৃতিক ব্যক্তি মনে করেন ভিউকে টার্গেট করে যা নির্মিত হচ্ছে এগুলো নাটক নয়, একেকটা কনটেন্ট। কার কনটেন্ট কত ভিউ হলো, কত টাকা এলো সেই হিসাব করে এখন। তাদের মতে, নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও মান কখনো এক হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাট্যজন তারিক আনাম খান বলেন, ‘নাটক এখন সস্তা বিনোদনের মাধ্যম হয়ে গেছে। সবাই চায় ভিউ, সঙ্গে রাতারাতি জনপ্রিয়তা। এখন তো চাইলে যে কেউ নাটক বানিয়ে ফেলছেন। গল্প, নামকরণ, সংলাপের মাধুর্য এর প্রতি গুরুত্ব নেই। একটি গোষ্ঠী তো চিত্রনাট্য ছাড়াই নাটক নির্মাণে অভ্যস্ত। এটা এ ইন্ডাস্ট্রির জন্য খারাপ দিক।’ এদিকে শিল্পের মানদন্ড হিসেবে ভিউ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে সংগীতশিল্পী কণার রয়েছে ভিন্নমত। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ভিউ গানের মানের ওপর নির্ভর করে না। তবে গানটি সম্পূর্ণভাবে করতে গেলে আপনার স্পন্সর লাগবে। বাণিজ্যিকীকরণের জন্য গানের ভিউটা তখন গুরুত্বপূর্ণ। ভিউ দিয়েই আসলে আয়টা করতে হবে। আবার ভিউ হলেই গানটা অনেক ভালো বা জনপ্রিয় তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে অনেক খারাপ গানও ভালো ভিউ হয়ে যায়, আর ভালো গান করেও ভিউ পাওয়া দুষ্কর হয়।’ ভিউবাণিজ্য প্রসঙ্গে অভিনেত্রী নওশাবা বলেন, ‘একসময় টেলিভিশন নাটকের যে ঐতিহ্য ছিল, তা তো শেষ এখন। ইউটিউব ও ওটিটির যুগে সবার ফোকাসে থাকে ভিউ। নাটকের গল্প, শিল্পীদের অভিনয়, পরিচালকের নির্দেশনা- সব ওই অর্থে আর নেই। ভিউ হয় এমন নাটকের পেছনে ছুটছে সবাই। ভিউ বাড়াতে নাটকের নামে এখন কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভিউ তারকাশিল্পী। সব মিলিয়ে ভিউ যেন এখন খুব দামি কিছু হয়ে গেছে, যেখানে জনপ্রিয়তা গৌণ।’ তরুণ অভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমির ভিউ নিয়ে দর্শন অবশ্য ভিন্ন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভিউ নিয়ে আমার আলাদা কোনো দর্শন নেই। মনে হয়, এটা যেকোনো প্রজেক্টের একটা অংশ। এত কষ্ট করে আমরা কাজ করি, তাই যখন ভিউ হয়, ভালো লাগে। কারণ, মানুষ দেখছে বলেই ভিউ হচ্ছে। প্রশংসা করছে, আলোচনা-সমালোচনাও করছে। এটা তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভিউর বিষয়টা সরাসরি জড়িত প্রযোজকদের জন্য, এখান থেকে টাকা উঠে আসার ব্যাপার থাকে। এখন আমার কাজ যদি না-ই দেখে, আমাকে নিয়ে প্রযোজক তো পরের প্রজেক্টে ভাববে না। তারা হয়তো বিকল্প সিদ্ধান্তে যাবে।’ অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সংগীতশিল্পী হাবিব বলেন, ‘এখন কিন্তু মানুষ সব গানই শোনে। আর সবসময়ই শোনে। তবে গানটা আগে সুন্দর হতে হবে। আমি মনে করি, ভিউ কখনোই মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, যা নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত থাকে এখন।’ সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারও ভিউ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে গানের ভিউ দিয়ে হয়তো জনপ্রিয়তা মূল্যায়ন করা যায়, কিন্তু সেই ভিউও কতখানি জাস্টিফাইড, সেটার সত্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।’ তবে এ সময়ে কিছু বিষয়ও লক্ষণীয়। নাটক বা গানের ভিউ হয়েছে অনেক কিন্তু সমালোচিতও হয়েছে সেটি। লাইকের তুলনায় ডিজলাইক বেড়েছে। তেমন গান বা নাটক ইউটিউব প্ল্যাটফর্মেও আছে। তার মানে দর্শক-শ্রোতারা দেখছেন বা শুনছেন ঠিকই, কিন্তু কনটেন্টগুলো সেভাবে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভিউ অনেক বেশি, এই ভেবে ইতিবাচক তৃপ্তি পাওয়া যাবে না।