মিথ্যা তিন প্রকার। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, পরিসংখ্যান। এটি খুবই প্রচলিত একটি প্রবাদ। মিথ্যা বলার বিষয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যানের বেলায় তা নেই। কারণ ধর্ম আবির্ভাবের সময় পরিসংখ্যান শব্দের জন্ম হয়নি। মিথ্যার এই চরমরূপ পরিসংখ্যান নিয়ে সব সময় বিতর্ক। প্রশ্ন জাগে, চরম এই মিথ্যার উৎস কোথায়? আপাতদৃষ্টিতে প্রাথমিক উৎস রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি, কখনো সরকার নিজেই। ফলে জনগণ পরিসংখ্যান নিয়ে সব সময় গোলকধাঁধায় থাকে। তবে কেউ অস্বীকার করবে না যে সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া কোনো বিষয়েই সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির খতিয়ান ‘কাজির গরুর’ মতো- খাতায় থাকে, গোয়ালে পাওয়া যায় না। আর আমাদের দেশের সরকারগুলো উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে বড় বড় গীত রচনা করে।
এ কথা সত্য যে সরকার প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু এ খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সেই মাত্রার উন্নয়ন সুবিধা জনগণ পায় না। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে বাড়তে থাকে ব্যয়। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের কারণে এই ব্যয় বাড়ে। কিন্তু সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবও ব্যয় বৃদ্ধির জন্য কম দায়ী নয়। এই ভৌতিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশেই বেশি। তাই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে সঠিক পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা আসলে কি অসম্ভব? অথচ সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সঠিক পরিসংখ্যান অপরিহার্য। তাই সরকারের কাছে সঠিক পরিসংখ্যান থাকার বিকল্প নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও জাতীয় পরিসংখ্যানের সঠিক চিত্র না থাকা সত্যিই বেদনাদায়ক।
দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস। ১৯৭৪ সালের ২৬ আগস্ট বিবিএস গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদমশুমারি কমিশন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিশুমারি কমিশন ও কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং পরিকল্পনা কমিশনের পরিসংখ্যান ব্যুরোকে একত্র করে বিবিএস গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের পরিসংখ্যানসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণে জনমিতিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য, অপরাধ ও বিচার ইত্যাদির ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেশের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা।
এই বহুমাত্রিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন একদল মেধাবী, দক্ষ, প্রশিক্ষিত, কর্মঠ কর্মী বাহিনী। জাতীয় উন্নয়নে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা এবং তার যথাযথ বিশ্লেষণ তুলে ধরার কাজটি গড়মানের কর্মীদের দিয়ে সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ১৪টি ক্যাডার নিয়ে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের যাত্রাকালে পরিসংখ্যানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠনকালে এই ক্যাডারকে বিসিএস (পরিসংখ্যান) নামকরণ করা হয়। একটি বিশেষ কাজে মেধাবী, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে সংশ্লিষ্ট কাজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা হয়। তবে সূচনাকাল থেকেই পরিসংখ্যান ক্যাডারের সাংগঠনিক কাঠামোটিও ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। ফলে জনবলসংকটে বিবিএস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এর সংস্কারে ক্যাডারের জনবল সুষমকরণ ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির পরিবর্তে ক্যাডারের উচ্চপদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রেষণে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা পদায়ন করে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, ব্যবস্থাপনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি গাণিতিক জটিল বিষয়ে কোনো ধারণা বা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডারের প্রেষণ পদায়ন পরিসংখ্যান ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ওপরে ওঠার পথও বন্ধ করে রাখে। আবার জাতীয় পরিসংখ্যানের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো দায় চাপে ব্যুরোর ক্যাডার কর্মকর্তাসহ অন্যান্য জনবলের ওপর।
১৯৮০ সালে গঠন করা এই ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা অদ্যাবধি মহাপরিচালক হওয়ার সুযোগ পাননি। এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নেই নিজস্ব কোনো প্রশিক্ষণ একাডেমি, ক্যারিয়ার প্ল্যান এবং পদোন্নতির যথাযথ সুযোগ। এমনকি পরিসংখ্যানবিষয়ক নীতিনির্ধারণ কিংবা জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নস্তরে ক্যাডারের কারও অংশগ্রহণ বা মতামত প্রদানেরও সুযোগ নেই! অন্যদিকে পরিসংখ্যানের মতো মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জটিল গাণিতিক কাজে মেধাবী কর্মকর্তার প্রয়োজন থাকলেও পরবর্তী সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অযৌক্তিকভাবে ব্যুরোতে নন-ক্যাডার পদ সৃজন করে। ফলে কর্মকর্তা পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্যুরোর ১০টি শেষ হওয়া প্রকল্পের ৫২টি প্রথম শ্রেণির পদ রাজস্ব খাতে আত্তীকরণের মাধ্যমে বিভাজনের সূচনা করা হয়। প্রকল্পের এই কর্মকর্তারা ননক্যাডার হিসেবে ব্যুরোতে যোগ দেন। ২০১২ সালে আরও দুটি ননক্যাডার পদ সৃজন এবং উপজেলা অফিসের ৪৮৩টি ক্যাডার পদ সৃজনের প্রস্তাবের বিপরীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০০টি ননক্যাডার পদ সৃজন করে। ফলে বিবিএস এখন ক্যাডার-ননক্যাডার দ্বন্দ্বের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব ক্যারিয়ার প্ল্যান ও সুষ্ঠু পদোন্নতির বড় অন্তরায়। যেখানে প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করার মতো ক্যারিয়ার প্ল্যান, সেখানে গড়মানের ননক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশকে ব্যাহত করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন বিদ্যমান ননক্যাডার পদগুলোকে প্রচলিত নিয়মে ক্যাডারভুক্ত করে গড়মানের কর্মকর্তা নিয়োগর পথ বন্ধ করা।
পরিসংখ্যানের ভৌতিক গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল একটি কার্যকর আইন। সেই আইন প্রণয়ন করতে সময়ে লেগেছে উনচল্লিশ বছর। ২০১৩ সালে প্রণীত আইনে জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থার রূপরেখা ও কার্যপ্রণালির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও নেই। পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনায় বিবিএস ব্যতীত অন্যান্য অনুষঙ্গীর পরিচয়, কর্মপরিধি, আন্তঃসমন্বয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি আইনে। তাই আইনটিও সংশোধনের দাবি রাখে। অন্যদিকে আইন অনুযায়ী সরকারি পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও প্রকাশের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন বিবিএস মহাপরিচালক। সেই মহাপরিচালক পদে আসীন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন উভয় ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু পরিসংখ্যান নিয়ে উত্থাপিত সব প্রশ্ন ও সমালোচনার দায় বর্তে পরিসংখ্যান ক্যাডারের কর্মকর্তা ও অন্যান্য জনবলের ওপর।
দেশের প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যানের জন্য প্রধানত দায়ী বিবিএস পরিচালনায় সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। বিবিএস পরিচালিত হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের’ সচিবের অধীনে। আইনে উল্লেখ না থাকলেও সচিবের সম্মতি নিয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়ার রেওয়াজ হয়ে গেছে। ফলে পরিসংখ্যানে শীর্ষ কর্মকর্তার সরকারের প্রতি আনুগত্য ও তুষ্টিবাদ অগ্রাধিকার পায়, কিন্তু সমুদয় দায় ব্যুরোকে বহন করতে হয়।
কাজির গরুর হিসাব খাতা ও গোয়ালে একই পেতে হলে প্রয়োজন বিবিএসকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা। পরিসংখ্যান ক্যাডারকে শক্তিশালী ও সঠিক ক্যারিয়ার প্ল্যানের মাধ্যমে মেধাবীদের এ ক্যাডারে যোগদানের বিষয়ে আকৃষ্ট করা। উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও নীতি প্রণয়নের কাজের জন্য গাণিতিক ও কারিগরিভাবে দক্ষ জনবলের কাজ গড়মানের কর্মকর্তা দিয়ে করার সুযোগ নেই। এমন সময়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিবিএসকে ‘কমিশন’ করার সুপারিশ করেছে। সংস্কার কমিশনের মতে, পরিসংখ্যান প্রণয়নে বিবিএসকে স্বাধীন ও সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতেই এই সুপারিশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো কমিশনের কর্মকাণ্ডই সন্তোষজনক নয়। দুই-একটি কমিশনের কিছু সুনাম থাকলেও সেগুলো এখন আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান কমিশনগুলো পরিণত হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত আমলা পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেই আমলাকেও হতে হয় ক্ষমতাসীন দলের অনুগত। মন্ত্রণালয়গুলোর কিছু জবাবদিহি থাকলেও কমিশনগুলো সেভাবে জবাবদিহি করে না। তা ছাড়া কমিশনগুলোর নিজস্ব কর্মচারীদের জন্য কর্মপরিবেশ ও ক্যারিয়ার সম্ভাবনার চিত্রও মেধাবীদের আকৃষ্ট করার মতো নয়। তাই গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী কাজের জন্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ক্যাডার সার্ভিসে রাখাই যৌক্তিক। প্রয়োজনে সহায়ক জনবলের বেলায়ও মেধাবীদের নিয়োগ করতে নিয়োগবিধি সংশোধন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ক্যারিয়ার প্ল্যানকেও আকর্ষণীয় করতে হবে। দুটি কমিশন ও দুটি ব্যুরোকে একীভূত করে গঠিত বিবিএসকে আবার কমিশনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব অবশ্যই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি দেশের সঠিক পরিসংখ্যান। রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যয়সাশ্রয়ী ও সময়াবদ্ধ রাখতে সঠিক পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার নিরপেক্ষ চিত্র নির্ভর করে জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার সঠিক তথ্য-উপাত্তের ওপর। আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ তাদের সদিচ্ছার কারণে শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন গতিশীল ও কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে একই পথ অনুসরণ করাই সমীচীন। তাই পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে মেধাবীদের নিয়োগ ও সুষ্ঠু ক্যারিয়র প্ল্যান তৈরি করা, তাদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পৃথক প্রশিক্ষণ একাডেমি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামো সুষমকরণ এবং সংস্কার কমিশনের সুপারিশকৃত অন্যান্য সার্ভিসের মতো গ্রেড-১ ও বিশেষ গ্রেড পর্যন্ত পদসোপান করতে হবে। অন্যথায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়বে। জাতীয় পরিসংখ্যনের গুণগত মানোন্নয়নে UN Fundamental Principles of Official Statistics (UNFPOS) Ges United Nations National Quality Assurance Frameworks (UNNQAF)-এর গাইডলাইন মাথায় রাখতে হবে। তা হলেই জাতীয় পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধা থেকে জনগণ মুক্তি পাবে। বেসরকারি পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও হবে সহায়ক।
লেখক : সাবেক ডিজি, ডিএফপি