বাংলা লোকসংগীতের ভান্ডারে এমন কিছু গান রয়েছে, যেগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের মনের গভীরে গেঁথে আছে। এমনই একটি কালজয়ী গান হচ্ছে- ‘শুয়া চান পাখি’। প্রয়াত বাউল সাধক বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে গাওয়া এ গানটি বাংলা লোকসংগীতের এক অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। গানটি হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয় এবং সেখানে উকিল মুন্সীর নাম গীতিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে গানটির রচয়িতা ও সৃষ্টি-প্রেক্ষাপট নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ ও বিভ্রান্তি, যা একদিকে যেমন লোকসংগীতের ভাবগম্ভীরতা বাড়িয়েছে, তেমনি গবেষকদের মাঝে সৃষ্টি করেছে বিতর্ক। অনেকের মতে গানটির মূল রচয়িতা রশিদউদ্দিন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির জন্য হাওর অঞ্চলের গান খুঁজছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সে সময় কোনো একজন ‘সোয়া চান পাখি’ তাকে সংগ্রহ করে দেন। যদিও একাধিক সংকলনেও গানটি রশিদউদ্দিনের বলেই উল্লেখ রয়েছে। গানটির শিরোনাম ‘শুয়া চান পাখি’-এখানে ‘শুয়া’ অর্থ শুয়ে থাকা, ‘চান’ অর্থ চাঁদ বা প্রিয়তম এবং ‘পাখি’ অর্থ প্রাণপ্রিয়া। পুরো বাক্যটির ভাবার্থ দাঁড়ায়- ‘শুয়ে আছে আমার প্রিয়তম পাখি।’
গানটির নেপথ্যের গল্প
এ গানটি নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ও আবেগঘন ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় বাউল সাধক উকিল মুন্সীর জীবন থেকে। জনশ্রুতি অনুসারে, উকিল মুন্সী একবার গান গাইতে গিয়েছিলেন দূরবর্তী এক গ্রামে, তখন তার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীনই স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পান। যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় তিনি তিন দিন পর বাড়ি ফেরেন এবং দেখতে পান, স্ত্রীকে কবর দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর কবরের পাশে বসে তিনি হঠাৎ গান ধরেন- ‘শুয়া চান পাখি আমার, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’। অন্যদিকে এ গানটি সৃষ্টির নেপথ্যে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিক ও পীর-মুর্শিদভিত্তিক তত্ত্ব। উকিল মুন্সীর পুত্রবধূ রহিমা খাতুন এ গানের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, এ গানটি স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে নয়, বরং উকিল মুন্সীর পীরসাহেব বাড়ির মোজাফফর আহম্মদ (রহ.)-এর মৃত্যু উপলক্ষে রচিত হয়। পীর-মুর্শিদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক এবং আধ্যাত্মিক প্রেমই এখানে ‘পাখি’ শব্দের মর্মার্থ বহন করে। এক গভীর তত্ত্বময় উপলব্ধি থেকে গানটি রচিত হয়, যেখানে শিষ্য তার গুরুপ্রেমে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন।
রচয়িতা নিয়ে বিতর্ক : উকিল মুন্সী না রশিদউদ্দিন?
‘শুয়া চান পাখি’ গানটির রচয়িতা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে উকিল মুন্সীর নাম প্রচারিত হয়ে এলেও অনেকে দাবি করেন, এ গানটি আসলে রশিদউদ্দিন রচিত। এ বিতর্ক আরও জটিল হয় যখন হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করা হয় এবং সেখানে উকিল মুন্সীর নাম গীতিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যদিও গানের দ্বিতীয় অংশ রশিদউদ্দিনের বলে পরিচিত। বারী সিদ্দিকী নিজেও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও স্টেজ পারফরম্যান্সে কখনো উকিল মুন্সীর কাহিনি তুলে ধরেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ‘হুমায়ূন স্যার গান দিয়েছেন, আমি গেয়েছি।’ ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টের এক অনুষ্ঠানে বা বিভিন্ন টিভি শোতে তিনি গানের দ্বিতীয় অংশ রশিদউদ্দিনের লেখা বলে উল্লেখ করেন। একটি চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠানে এ গানটি নিয়ে কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘কবরের পাশে গান রচনা হয়েছিল। আমি সংগ্রহ করেছি মাত্র। উকিল মুন্সীর গান। বাউল রশিদউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে...মৃত লাশ...উকিল মুন্সী স্ত্রীর লাশকে কোলে নিয়ে গানটা গেয়েছিলেন। কোন সুরে কোন তালে...আমি সংগ্রহ করেছি মাত্র।’ এটি থেকে বোঝা যায়, গানের দুটি অংশ দুজনের লেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিতর্ক এখনো চলমান। এ বিতর্ক হয়তো চলবে আরও বহু বছর। তবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে গানটি যা আমাদের দেয়, তাহলো চিরন্তন ভালোবাসা ও অপূরণীয় বিচ্ছেদবোধের এক সংগীতায়িত রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক। লেখকের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও গানটির আবেদন অম্লান। তাই বলা যায়- ‘শুয়া চান পাখি’ এখন আর কারও ব্যক্তিগত গান নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাংলার আত্মার গান। এটি ভাটির কান্না, হাওরের আকাশ, প্রেম-প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহ, আবার কখনো আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনের গান। এ গানে মানুষের মনের দহন, প্রেমের অশ্রু ও মৃত্যুর ছায়া-সব একত্রিত হয়ে জীবনের চূড়ান্ত সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। গানটি প্রমাণ করে, একটি গান শুধু সংগীত নয়, এটি ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের এক অনবদ্য সমন্বয়।