এক. গণতন্ত্র মানে জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা। গণতন্ত্র মানে দেশ পরিচালনার ভোটাধিকার। জানামতে, ২০০ বছর আগেও গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না কোনো দেশে। বাংলাদেশের মানুষ গর্ব করতে পারে, এ দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর আগে। গণতান্ত্রিকভাবে পাল বংশের প্রথম রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন গোপাল। আমাদের এই ভূখণ্ডে তখন ছিল এক অন্ধকার যুগ।
শশাঙ্ক রাজবংশের পতনের পর শত বছর বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। ছিল না আইনশৃঙ্খলা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব। কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে জমিদার বা সমাজপতিদের দৌরাত্ম্য সীমা অতিক্রম করে। দেশজুড়ে বিরাজ করছিল মাৎস্যন্যায়। জলাশয়ে বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমন অরাজকতা ছিল বাংলাজুড়ে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ছিল সমাজপতিদের অনুসরণীয় নীতি। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সীমাহীন নৈরাজ্যে। ঠিক সেই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় এ নৈরাজ্য আর নয়। তারা শূন্য সিংহাসনে সবার মতামত নিয়ে কাউকে নতুন রাজা নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সৎ ও সাহসী যুবক গোপালকে নির্বাচিত করা হয় বাংলার রাজা। শুরু হয় পাল বংশের শাসন। গোপালের রাজা নির্বাচিত হওয়া নিয়ে প্রচলিত রয়েছে মজার কাহিনি। যে কাহিনি ঠাকুরমার ঝুলির কাহিনিকেও হার মানায়।
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতি ভাষায় লিখিত লামা তারানাথের লিখিত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস এবং খালিমপুর লিপির শ্লোকে গোপালের সিংহাসনে আরোহণের বর্ণনা পাওয়া যায়। তারানাথের কাহিনির মর্মার্থ শত বছরের অরাজকতায় বাংলার জনগণের দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে আইনানুগ শাসন প্রতিষ্ঠায় একজন রাজা নির্বাচন করেন। কিন্তু নির্বাচিত রাজা সে রাতেই এক কুৎসিত নাগরাক্ষসীর হাতে নিহত হন। এভাবে প্রতি রাতে একজন নির্বাচিত রাজা নিহত হতে থাকেন। অবশেষে একদিন চুণ্ডাদেবীর এক ভক্ত একটি বাড়িতে আসেন। ওই বাড়ির সবাই খুব বিষণ্ন। কারণ ওই দিন রাজা হওয়ার ভার পড়েছে ওই বাড়িরই এক ছেলের ওপর। আগন্তুক ওই ছেলের বদলে নিজে রাজা হতে রাজি হন। সেই রাতে যুবক রাজা লাঠি দিয়ে আঘাত করলে রাক্ষসী মারা যায়। পরদিন রাজাকে জীবিত দেখে সবাই অবাক। পরপর সাত দিন তিনি অস্থায়ীভাবে রাজা নির্বাচিত হন। অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাঁকে স্থায়ী রাজা নির্বাচিত করে এবং তাঁকে গোপাল নাম দেওয়া হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই রাজবংশ ৪০০ বছর বাংলা শাসন করে। বাংলার বাইরে বিহার, উড়িষ্যা, কামরূপেও বিস্তৃত হয় পাল সাম্রাজ্য। পাল বংশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষজুড়ে।
বলা হয় শুরু থাকলে শেষও থাকে। পাল বংশ ৪০০ বছর টিকে থাকলেও কর্ণাটক থেকে আসা সেনদের হাতে তাদের পতন ঘটে। সেনরা প্রথম দিকে ছিল পালদের সামন্ত রাজা। একপর্যায়ে তারা স্বাধীন রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রায় শত বছর ছিল সেন শাসন। লক্ষ্মণ সেন ছিলেন সেন বংশের শেষ প্রভাবশালী রাজা। তাঁর শাসনামলে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজি আকস্মিক হামলা চালিয়ে নদীয়া দখল করেন। বিনা যুদ্ধেই বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন নদীপথে পালিয়ে আসেন বিক্রমপুরে। বাদবাকি জীবন তিনি বিক্রমপুরে থেকেই বাংলার বড় অংশ শাসন করেন। বখতিয়ার খিলজির রাজত্ব ছিল নদীয়া ও বাংলার পশ্চিম অংশে। ভাটির এলাকা নিয়ে তুর্কি বীর বখতিয়ারের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তিব্বত অভিযানের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সেই স্বপ্নই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ব্যর্থ তিব্বত অভিযান শেষে রাজধানীতে ফেরার পথে নিজের লোকদের হাতেই তিনি প্রাণ হারান।
বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর আগে গণতান্ত্রিকভাবে রাজা নির্বাচনের ঐতিহ্য থাকলেও গণতন্ত্র এ ভূখণ্ডে বরাবরই একটি বিমূর্ত বিষয়। পাকিস্তানের ২৩ ও বাংলাদেশের ৫৪ অর্থাৎ গত ৭৭ বছরে গণতন্ত্র বারবার উঁকি দিলেও তা স্থায়ী হতে পারেনি। এজন্য সরকার, বিরোধী দল এমনকি ভোটারদের দায়ও কম নয়। গণতন্ত্রের জন্য যে মনমানসিকতার প্রয়োজন তার অভাব থাকায় এ দেশে গণতন্ত্র ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হচ্ছে তা ১৮ কোটি মানুষের এ জাতির কাছে গণতন্ত্র নামের সোনার হরিণ ধরা দেবে কি না, সে নিশ্চয়তা পাওয়া আদতেই কঠিন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর মতো আগামী নির্বাচনও যাতে একতরফা হয় সে প্রস্তুতিই চলছে। আগের তিন নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত ছিল অনুপস্থিত। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে না। তারপরও দেশের সচেতন মানুষ চায়, দ্রুত নির্বাচন হোক। যে চেহারারই হোক, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসুক। তাতে আর যা-ই হোক, বাংলাদেশের মানুষ এনজিওদের নিয়ে গড়া অরাজনৈতিক সুশীল সরকারের হাত থেকে রক্ষা পাবে। রূপকথার ভূতের মতো পেছনের দিকে হাঁটার নিয়তি থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ।
দুই. শান্তিতে নোবেলজয়ী ড মুহাম্মদ ইউনূসের সুশীল সরকারের এক বছর পূর্তি হবে আর সপ্তাহখানেক পরেই। দুনিয়াজুড়ে ড. ইউনূসের পরিচিতি খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ হিসেবে। বিশ্বকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্নও দেখান তিনি। এক বছর আগে তিনি যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন আশায় বুক বেঁধেছিল দেশের ১৮ কোটি মানুষ। কিন্তু বছর না পেরোতেই আশা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখন পঙ্গু অবস্থায়। সবারই জানা, জুলাই গণ অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু সেই গণ অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে চূড়ান্তভাবে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের সরল বিশ্বাসী উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। এ সরকারের পেছনে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ রয়েছে বলে ভাবা হয়, সেহেতু ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্কের বিষয়টি সহজেই সমাধান করা যাবে। যে কারণে দরকষাকষিতে সক্রিয় হওয়ার বদলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় সময় কাটিয়েছেন। ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের সুযোগ পেয়েও তাঁরা কাজে লাগাতে পারেননি। ৯০ দিনের সময়সীমা উঠে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিস্থিতি আরও বেশি অস্বাভাবিক হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা ছুটে যান ওয়াশিংটনে। সে সময়ও কোনো ব্যবসায়ী প্রতিনিধিকে সঙ্গী করা হয়নি। অথচ এই একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক প্রতিযোগী দেশ সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্য সচিব স্বীকার করেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অতীতে কখনো এমন বেকায়দায় পড়েনি। পোশাক রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনায় সরকার তাদের আস্থায় রাখেনি। অতীতে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যত সমস্যা হয়েছে তাতে রপ্তানিকারকরাই দরকষাকষিতে ভূমিকা রেখেছেন। অতীতের সব রাজনৈতিক সরকার ব্যবসাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব এদের এড়িয়ে চলা। এই আত্মঘাতী প্রবণতা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে খাদের কিনারায়। যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে তারা সে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ২৫টি বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ বিমান ঐতিহ্যগতভাবে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তার পেছনে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে সরকার লোকসান বাড়াতে চাচ্ছে। বাড়তি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, সয়াবিন ও গম কেনার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন নাকি দাবি করছে আরও বড় কিছু!
তিন. বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সব সেরা অর্জন এসেছে রাজনীতিকদের হাত ধরে। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কঠিন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের রাজনীতিকরা। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। মুক্তিবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানীও ছিলেন একজন জনপ্রতিনিধি। উপপ্রধান জেনারেল আবদুর রবও ছিলেন সত্তরের নির্বাচনে জিতে আসা ব্যক্তিত্ব। মুক্তিবাহিনীকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এর নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধিদের বসানো হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কৃতিত্ব কোনো সুশীলের নয়, রাজনৈতিক সরকারের। স্বাধীনতার পর মুজিব সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হয়েছে শূন্য হাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল শূন্য। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার দায়িত্ব পড়েছিল তাদের ওপর। সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারকে এক কোটি শরণার্থী পুনর্বাসনে কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য স্থাপনা, সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট মেরামতের দিকে নজরও দিতে হয়েছে। ওই সরকারের সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ৭ শতাংশ হারে। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বাংলাদেশের সমৃদ্ধির রূপরেখা প্রকৃত অর্থে প্রণীত হয় বিএনপির শাসনামলে। সংসদে বাজার অর্থনীতির প্রস্তাব আনা হয় সে সময়ে। বিরোধী দল আওয়ামী লীগও তাতে সায় দেয় বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার ঐতিহ্য থেকে সরে এসে।
বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ উন্মোচিত হয় ওই রাজনৈতিক সরকারের আমলেই। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২০০-এর বেশি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে ৩৪তম স্থানে। যে দেশের মানুষ একসময় বিদেশ থেকে আসা পুরোনো কাপড় পরে লজ্জা নিবারণ করত, তারা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে নব্বই-পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলে। সংগত কারণেই দেশের ওপর যে সমস্যার পাহাড় চেপে বসেছে, তার মোকাবিলায় রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
ইমেইল : [email protected]