উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো মেগা প্রকল্পগুলো যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণের টাকায় ডজন ডজন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়নের ধীরগতিতে এসব প্রকল্পের সুফল অধরাই থেকে যাচ্ছে। পাঁচ বছরের প্রকল্প শেষ হচ্ছে না ১৩ বছরেও। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় প্রতিশ্রুতি ফি বাবদ গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ ডলার জরিমানা। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামায় বাড়ছে ঋণের খরচ। এতে কমে যাচ্ছে প্রাপ্য ঋণের মোট পরিমাণ।
ধীরগতির কারণে ঋণদাতা সংস্থাগুলোও এখন এসব প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঋণের অর্থ অন্য প্রকল্পে স্থানান্তরের কথা চিন্তা করছে ঋণদাতা সংস্থাগুলো। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অন্তত ৬৫টি উন্নয়ন প্রকল্প ধীরগতিতে চলছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। তার মধ্যে ১০ বছরেও ঋণের ১০ শতাংশ ব্যয় করতে পারেনি এমন প্রকল্পও রয়েছে। শুধু এডিবির অর্থায়নে অন্তত ১৬টি ধীরগতির প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। গতি না বাড়লে এসব প্রকল্প থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে এডিবি। এসব নিয়ে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ত্রিপক্ষীয় পর্যালোচনা বৈঠক (টিপিআরএম) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে প্রকল্পগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সরকার নিজেই ৮১ কোটি ডলারের বেশি অন্য প্রকল্পে সরিয়ে নিয়েছে।
ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, এডিবির অর্থায়নে চলমান প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রকল্পকে ‘সমস্যাজনক’ ও ‘ধীরগতির’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোট ১৬টি ধীরগতির প্রকল্প নিয়ে টিপিআরএম বৈঠকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে চলমান প্রায় ৭০টি প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হবে। ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে ১১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (উইং-৫ এর প্রধান) এস এম জাকারিয়া হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৈঠকে এডিবি, ইআরডি ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো থাকবে। এটা খুবই স্ট্যান্ডার্ড মিটিং। প্রতি বছর দুবার হয়। প্রকল্পগুলোর ধীরগতির কারণ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থ অন্য প্রকল্পে স্থানান্তরের কোনো আশঙ্কা নেই। প্রকল্পগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে যা করণীয় তা করব।
এদিকে নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচবারও বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গাজীপুর-এয়ারপোর্ট বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি অনুমোদন হয় ২০১২ সালে। দফায় দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েও শেষ হয়নি ২০.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির কাজ। অথচ পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। গত ২৭ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের ১২তম একনেক সভায় ৫৪.৫৭ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পের চতুর্থ সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ২,৩২৯ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬,৫৯৭.৩২ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অথচ মূল প্রকল্প ব্যয় ছিল ২,০৩৯.৮৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর বাড়ানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তবে সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় একনেকে। একই সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ এ প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই প্রণয়নের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ অসমাপ্ত প্রকল্প এখন টঙ্গী এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় তিন ডজন মাঝারি ও বড় প্রকল্পের ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে ঋণদাতাদের। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন বিনিয়োগ প্রকল্প (লাইন ৫, দক্ষিণ রুট), দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) ঢাকা-উত্তর-পশ্চিম করিডর সড়ক প্রকল্প (দ্বিতীয় ধাপ- ট্রাঞ্চ ৩), সুরমা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনর্বাসন প্রকল্প, চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ মাল্টিমডেল রুট প্রকল্প, ঢাকা পরিবেশগতভাবে টেকসই পানি সরবরাহ প্রকল্প, বৃহত্তর ঢাকা টেকসই নগর পরিবহন প্রকল্প, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প। এর মধ্যে ২০১১ সালে গৃহীত প্রকল্পও রয়েছে।
ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো বাদও দেওয়া যাচ্ছে না, চালিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রকল্পগুলোর কারণে বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা চাপছে দেশের ওপরে। ধীরগতির কারণে অনেক প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বছরের পর বছর মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। ধীরগতির কারণে বিপুল পরিমাণ জরিমানা দিতে হচ্ছে। আবার প্রকৃত ঋণের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এডিবি ২০১১ সালে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ছয় বছরের প্রকল্প, এখন ১৪ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি চার্জ হিসেবে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্প বিলম্বের ফলে মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিময় হারের ওঠানামার কারণে ঋণের খরচ প্রায় ৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঋণের মোট পরিমাণ অন্তত ১০ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে এডিবি সহায়তা দিয়েছে ২.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, এডিবি বাংলাদেশকে ৭৪০টি সরকারি খাতে ঋণ, অনুদান ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে, যার মোট পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে এডিবির সার্বভৌম ঋণ পোর্টফোলিওতে রয়েছে ১১.০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৬৭টি ঋণ ও ৩টি অনুদান। পূর্বের টিপিআরএম বৈঠকে প্রকল্পের গতি না বাড়লে অর্থ অন্য প্রকল্পে সরিয়ে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল এডিবি। বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইআরডি।