দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও কঠোর হচ্ছে বিএনপি। দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় এমন অভিযোগ যে পর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধেই উঠুক না কেন কোনো ছাড় নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কঠোর হচ্ছে বিএনপি। দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই সাংগঠনিক শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। চাঁদাবাজি, দলবাজি, ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে প্রায় ৭ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিএনপির নেতা-কর্মীর নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে কি না সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে আগামী নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিচ্ছে দলটি।
জানতে চাইলে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশে কোথায় কী ঘটছে, কারা কী করছে-খবর পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এ ধরনের যত তথ্য পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ইতোমধ্যে বিএনপি এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ৫-৬ হাজার নেতা-কর্মী, যারা দলের নামে, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নামে, সহযোগী সংগঠনের নামে দুর্বৃত্ত চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে অথবা দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তুলেছিল, অনৈতিক কাজের মধ্যে ছিল, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিএনপি এবং এর নেতারা ‘আপসহীন’ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘একেবারে জিরো টলারেন্স’ নীতিতে আছেন। নানা অভিযোগে বিএনপির ৭ হাজারের বেশি দলীয় সদস্যের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি জানান, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণের দায়ে কেউ পদচ্যুত হয়েছেন, আবার অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন। সম্প্রতি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা জানান তারেক রহমান।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঘিরে সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে চান। দলের এমন মনোভাবের মধ্যে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে একটি ষড়যন্ত্রকারী মহল। অনেকে নব্য বিএনপি সেজে অপকর্ম করছে। কেউ অতিউৎসাহী হয়ে দলের ক্ষতি করছে। দোষী সবাইকে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের কথা বলছেন। তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কিছু বরদাশত করা হবে না। এ ছাড়া ইদানীং অনেক নেতার ছত্রছায়ায় নব্য বিএনপি তৈরি হচ্ছে, যারা সুযোগে ফায়দা লুটবে। এজন্য হাইকমান্ড দলে নতুন সদস্য নেওয়া আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে।
নেতারা জানান, অনেক বাজার-বন্দরে বিএনপির তরফ থেকে মাইকিং করে চাঁদাবাজদের রুখে দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। দলের কেউ জড়িত থাকলে প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএনপির কিছু বিভ্রান্ত নেতা-কর্মী মনে করছেন ক্ষমতার করিডরের কাছাকাছি চলে এসেছেন। অনেকে নিজ নিজ এলাকায় আস্তানা গেড়েছেন। নিজেদের বলয় বৃদ্ধি করে মুহূর্তেই প্রভাবশালী বনে গেছেন। সাংগঠনিক নিয়ম-নির্দেশনা কিংবা শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে নিজেরাই করছেন এলাকার বিচার-সালিশ। যেখান থেকে আদায় করে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। দেশের কোথাও না কোথাও পূর্বশত্রুতা পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক কলহের জেরে জমি, ব্যবসাবাণিজ্য দখল, অর্থ আত্মসাতের ঘটনা রোজই ঘটছে। বিএনপি এসব বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া মাত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কোথাও সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীকে আইনের হাতেও তুলে দিচ্ছে।
বিএনপির দপ্তর থেকে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে এসব ঘটনায় দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় ৩ হাজার ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মী রয়েছেন ১ হাজার ৮০০ জন। এদের মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিস, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আরও অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছাত্রদল এখন পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬ শতাধিক নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতা-কর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণ দর্শানো নোটিস পেয়েছেন, যুবদলেরও শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আবেদনের ভিত্তিতে অনেকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হচ্ছে।
ক্লিন ইমেজধারী-ত্যাগীদের মনোনয়ন দেবে বিএনপি : বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। দখলদারি, চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত নেতারা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, তাদের কোনোভাবেই দলীয় টিকিট দেওয়া হবে না। তারেক রহমান ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন এবং এ নির্বাচনে দলকে জনগণের আস্থার ভিত্তিতেই জয়লাভ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে এমন কাউকে মনোনয়ন থেকে দূরে রাখার বিষয়ে তিনি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন।