গত এক সপ্তাহ আমরা সবাই খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমরা বলতে আমি কিংবা আমার পরিবার নয়, পুরো দেশবাসী ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছিল। আর সেই সুযোগে সরকার বড় বড় দম ফেলার সুযোগ পেয়েছিল। আমাদের ব্যস্ততা ছিল ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধে ইরানের কী হবে-শিয়ারা কী মুসলমান অথবা ইমাম মাহদি-মালহামা-দাজ্জালের আগমন নিয়ে একশ্রেণির মানুষের ব্যস্ততা ছিল লক্ষ করার মতো। অন্যদিকে ইসরায়েল-ইহুদিবাদ এবং মোসাদ নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। কারা বাংলাদেশে মোসাদের এজেন্ট অথবা আমেরিকার তাঁবেদাররা মুসলিম উম্মাহর কী কী সর্বনাশ ঘটিয়ে বাংলায় দাজ্জাল এবং সমকামিতাকে কীভাবে ঢোকাবে সেসব আলোচনার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর আন্দোলন অথবা সচিবালয় কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্দোলন যে কীভাবে কী হয়ে গেল, তা আমরা টেরই পেলাম না।
উল্লিখিত ঘটনাপুঞ্জির মধ্যে একটি নবীন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর যৌনালাপ, সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা এবং গালে জুতোর চুম্বনদৃশ্য যেমন তোলপাড় সৃষ্টি করেছে, তেমনই আরেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের গ্রেপ্তার এবং আদালতে তার জবানবন্দি সারা দেশে নতুন ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছে। সিইসি নূরুল হুদাকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন মব সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা হাবিবুল আউয়ালকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল। শোনা যায়, তিনি নিজেই কর্তৃপক্ষকে ফোন করে তাকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করেছিলেন। গ্রেপ্তারের পর ডিবি অফিসে রাতযাপন এবং পরের দিন কোর্টে হাজিরা ইত্যাদি কারণে তার সবকিছু আউলাঝাউলা হয়ে গিয়েছিল। ফলে কোর্টে জবানবন্দি দিতে গিয়ে তিনি যা কিছু বলেছেন, তা যেন ভবিষ্যতে তার জন্য বর্তমান সময়ের চেয়েও মহাবিপর্যয় তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত জেলখানা এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীতে ভরপুর। সেখানকার বাসিন্দারূপে তার অবস্থান সম্পর্কে তিনি হয়তো চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাননি। ফলে আদালতে প্রদত্ত তার জবানবন্দি এবং আবেগময় অভিব্যক্তির প্রতিক্রিয়া কর্তৃপক্ষকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
সপ্তাহের আলোচিত ঘটনাপুঞ্জির মধ্যে জাতীয় ফল মেলায় মব সৃষ্টি এবং সদলবলে ফল লুটের মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের একটি বিস্ময়কর উক্তিও সরকারকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলাপ-আলোচনার জন্য যেসব সংস্কার কমিশন এবং ঐকমত্য কমিশন করেছে সেখানকার নানা রাজকীয় খাওয়াদাওয়া, খোশগল্প এবং অকাজ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সালাহউদ্দিন বলেছেন, ওখানে কাজের চেয়ে খাওয়াদাওয়া ও খোশগল্পই বেশি হয়।
সরকারের কথিত সংস্কার প্রকল্প ও ঐকমত্য কমিশন নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক তুঙ্গে। কেউই বিশ্বাস করছে না যে ভবিষ্যতে সত্যিকার অর্থে কোনো সংস্কার হবে অথবা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দল এবং সরকার দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে। বরং বেশির ভাগ মানুষ মনে করছে, সরকার সময় নিচ্ছে, সময় পার করার চেষ্টা করছে এবং রাজনীতিকে জটিল, কুটিল ও ঘোলাটে করার জন্য সর্বোচ্চ কৌশল অবলম্বন করছে। সরকারের কর্মকাণ্ডে ধারাবাহিকতা নেই এবং সরকারকে বিশ্বাস করা যায় এমন কোনো ঘটনা আজ অবধি ঘটেনি। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে ক্ষমতার বলয়গুলো থেকে যা কিছু বলা হচ্ছে, যা কিছু করার চেষ্টা হচ্ছে অথবা যা কিছু আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তা জনগণ বিশ্বাস করছে না। বরং অজানা আশঙ্কা ও আতঙ্কে জনজীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আমাদের সাম্প্রতিক অতীতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং সরকারি ব্যর্থতার জ্বলন্ত ঐতিহাসিক দলিলের নাম এক-এগারো। দুর্নীতি-অনিয়ম, মোনাফেকি, দাম্ভিকতা, জুলুম-অত্যাচার ও পাপাচারের ষোলোকলা পেকে-পচে দুর্গন্ধময় হওয়ার পর এক-এগারো অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। এক-এগারোর প্রেক্ষাপটের চেয়েও ভয়ানক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে। ফলে আপনি যদি রাজনীতির সাধারণ গণিত বোঝেন, তবে নিশ্চিন্তে দুটো সমীকরণ দাঁড় করাতে পারেন। প্রথমত এক-এগারোর যে পরিণতি তার চেয়ে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব বা গণ অভ্যুত্থানের পরিণতি ভয়ানক হবে। দ্বিতীয়ত এক-এগারোর সরকার যে ভুল করেছিল, তা যদি বর্তমান সরকার করে, তবে অতীত বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়ানক বিপর্যয় পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলবে।
উল্লিখিত সমীকরণের আলোকে আপনি যদি চলমান সমস্যা এবং সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন তবে দেখবেন যে এক-এগারোর মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সদস্যদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা বর্তমান জমানার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। দ্বিতীয়ত সেই সময়ের সরকার বর্তমানকালের মতো সরকারি কাজকর্মের মধ্যে সংস্কারনামীয় বেহুদা কাজকর্মের সংমিশ্রণ ঘটায়নি। তখনো কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেদিন আর এদিনের পার্থক্য হলো-তখন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য এবং পরীক্ষিত লোকদের দিয়ে কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে দলের সবচেয়ে মেধাবীদের জড়ো করে সংস্কারবাদী গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল।
বিএনপির আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমান, মেজর (অব.) হাফিজদের মতো শীর্ষনেতাদের সামনে রেখে যেভাবে প্ল্যান করা হয়েছিল, তা যেমন দেশে আলোড়ন তুলেছিল, তদ্রুপ ড. ইউনূস ও ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর মতো সর্বজনস্বীকৃত মেধাবী, শিক্ষিত ও সফলদের দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছিল, যার সঙ্গে বর্তমানের কিংস পার্টিগুলোর তুলনা করলে রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যেও টিকটিকির লেজের বার্গার খাওয়ার লিপ্সায় শরীরে যে উত্তেজনা দেখা দেবে, যা নিরসনের জন্য নেতা-নেত্রীরা যৌনালাপের ভাইরাল কলঙ্কের নতুন ইতিহাস রচনা করে জাতিকে গলাধঃকরণের চেষ্টা চালাবে।
যা বলছিলাম, এক-এগারোর মেধা-মনন, চেষ্টা-তদবিরের সর্বোচ্চ সফলতার পরও তারা ব্যর্থ হয়েছিল মূলত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, শীর্ষ ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখানো, অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং অনেককে মামলা-মোকদ্দমার জালে ফেলে অপদস্থ করার কারণে। অধিকন্তু সারা দেশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে প্রান্তিক ব্যবসায়ী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং খেটে খাওয়া মানুষের মনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল তার ফলে এক বছরের মাথায় দেশের পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধপাস করে পড়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে থেমে যায় অথবা টিপটিপ করে জ্বলতে থাকে।
তখনকার জমানায় মব ছিল না। সরকারি অফিস-আদালতে স্বাভাবিক চেইন অব কমান্ড ছিল। তিন বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজেপির কর্মকাণ্ডের চমৎকার সমন্বয় ছিল। প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি, সচিবালয় এবং দুদকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামান্যতম দূরত্ব ছিল না। উল্টো রাজনৈতিক সরকারের আমলের চেয়ে তাদের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় অধিকতর কার্যকর ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সমঝোতা ছিল চমৎকার এবং দেশের আমজনতা আইন-আদালত ও বিধিব্যবস্থার প্রতি ছিল অনুগত। ফলে এক-এগারোর সময় শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়ার গ্রেপ্তারের পরও সামান্য অস্থিরতা লক্ষ করা যায়নি।
উল্লিখিত অবস্থার সঙ্গে যদি ২০২৫ সালের জুন মাসের বাস্তব পরিস্থিতির তুলনা করেন, তবে দেখতে পাবেন যে কোথাও চাল আছে তো চুলো নেই। ঘরের বেড়া আছে তো দরজা নেই। কিংবা অন্ধকারে বাতি জ্বালানোর জন্য তেল আছে তো হারিকেন নেই। অথবা বাতি আছে তো বিদ্যুৎ নেই। একইভাবে সরকার আছে তো আইনকানুনের বালাই নেই। ব্যাংক আছে কিন্তু ব্যবসা করার টাকা নেই। পুলিশ আছে কিন্তু মনোবল নেই। আর্মি আছে কিন্তু জনমনে স্বস্তি নেই। ফলে সারা দেশে এমন এক অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয়েছে, যার সম্ভাব্য পরিণতি আন্দাজ করার মতো নেতা বা নেত্রী নেই। এক-এগারোর সময় ব্যবসাবাণিজ্যের যে বেহাল ছিল, তার চেয়ে ১০ গুণ বেহালের মধ্যে পড়েছে দেশের শিল্প-বাণিজ্য। তখনকার অর্থনৈতিক সংকটকে যদি আপনি রুই-কাতলার সঙ্গে তুলনা করেন, তবে বর্তমান সংকট অবশ্যই আটলান্টিক সাগরের সবচেয়ে বড় নীল তিমির সমপর্যায়ের। এক-এগারোর সময় কেউ সমস্যায় পড়লে রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ ছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র নিজে উদ্যোগী হয়ে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পকারখানায় আগুন দিয়ে ছারখার করার পরও রাষ্ট্রের টনক নড়ছে না। শত শত বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মব তৈরি করে তছনছ করার পরও মব সন্ত্রাসের উল্লাসনৃত্য থামছে না। অধিকন্তু আরও নিত্যনতুন মবের জন্য উসকানি দেওয়া হচ্ছে। ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের এগারো মাসের মাথায় অর্থনীতির শনির দশার যে চিত্র বাংলার আকাশবাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে, তা পৃথিবীর সবাই দেখতে পেলেও আমাদের কলিকালের সংস্কারবাদীরা দেখছেন না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক