১০ মাস সময়ের মধ্যে দেশে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক স্বস্তি ফিরে এসেছে। দেশবাসী বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, বর্তমান সরকার পাঁচ বছর থাকতে চায় না। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে তারা সম্মানজনক প্রস্থান চায়। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যাঁরা পাঁচ বছরের উচ্চাভিলাষ পোষণ করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁদের আশাহত করেছেন। নির্বাচন নিয়ে যে অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর তা আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। সংস্কার ও ফ্যাসিস্টদের বিচারের ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কেউ বলছেও না, এ দুটি করা যাবে না। দেশের রাজনীতিতে একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হোক এটা সবাই প্রত্যাশা করে। সে প্রত্যাশা পূরণে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির দরকার। সেটা সম্ভব শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে। কোনো পক্ষভুক্ত না হয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জাতি প্রত্যাশা করে। তবে দুই নেতার সফল বৈঠকের পর অনেকেরই মন খারাপ। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে যারা মাইনাস করতে চেয়েছিল, তা করতে না পেরে তাদের মন খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। সাদা চোখে এখন অনেক কিছুই স্বাভাবিক দেখালেও যে ষড়যন্ত্র তারা শুরু করেছে, তা বন্ধ হয়েছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সুতরাং আগামী নির্বাচন পর্যন্ত সাবধানে পথ চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘ওয়ান্স এ বিট্রেয়ার, অলওয়েজ এ বিট্রেয়ার।’
অনেক দিন যাবৎ কানাঘুষা চলছিল, প্রধান উপদেষ্টার চারপাশে একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। সে দেয়ালের কারণেই তিনি দেশের প্রকৃত তথ্য পাচ্ছেন না। তাঁর তোতা পাখিরা যা বলতেন, তিনিও সরল বিশ্বাসে তা গ্রহণ করতেন। যার প্রমাণ আমরা পাই তাঁর জাপান সফরের মাধ্যমে। তিনি সেখানে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, একটি দল ছাড়া কেউ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় না। সে বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার ইমেজ ক্ষুণœ হয়। তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা চার দেয়ালের বাইরে এসে তিনি হয়তো সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সে কারণেই লন্ডন বৈঠক সফল হয়েছে। ব্যক্তিজীবন হোক বা রাজনীতি, সদিচ্ছা থাকলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। লন্ডন আলোচনায় সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। এ বৈঠক এতটা সফল হবে, তা ষড়যন্ত্রকারীরা কল্পনাও করতে পারেনি। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার চারপাশের দেয়ালও বৈঠকের সফলতা সম্পর্কে অনুমান করতে পারেনি। সবাইকে তাক লাগিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছেন দুই নেতা। লন্ডন বৈঠকে জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্টের পর প্রধান উপদেষ্টার ওপর পূর্ণ আস্থা ও যথাযথ সম্মান রেখেছেন তারেক রহমান। সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান জানানো তারেক রহমানের পারিবারিক শিক্ষা। তিনি দেখেছেন, তাঁর পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কীভাবে মানুষকে সম্মান করতেন। তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। নিতান্তই ব্যক্তিগত আক্রোশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্মান করছিলেন, তখন বেগম জিয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি পূর্ণ সম্মান ব্যক্ত করেন। শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এখন সবকিছু নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার ওপর। তিনি নির্বাচনের একটা সময় উল্লেখ করেছেন। এখন দরকার রোডম্যাপ। এ কাজটি করবে নির্বাচন কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা যত দ্রুত নির্বাচন কমিশনকে সবুজ সংকেত দেবেন, কাজটি ততই সহজ হবে। তা না হলে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারও অপতৎপরতা শুরু করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, তিনি একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেবেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা এখনো নষ্ট হয়নি। একটি মহল তাঁকে অন্ধকারে রেখে ইমেজ নষ্টের অপচেষ্টা করলেও তিনি তা অনুধাবন করতে পেরেছেন। সে কারণেই তিনি অতীতের বিতর্কিত নির্বাচনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে বিতর্কিত তিন জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। গত সোমবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। বিতর্কিত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনারগণ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই জুলাই সনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমি আশা করি, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে আমরা এটি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব।’ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর লন্ডন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে তারা সংস্কার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহী। তারা বিস্তারিতভাবে ঐকমত্য কমিশনের কাজ নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে, মতামত দিয়েছে। যেখানেই গেছি সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো?’ আমাদের প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট এবং আর কী কী অপশন আছে সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’
নির্বাচন বিষয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরলেও অর্থনৈতিক সেক্টরে এখনো স্বস্তি ফেরেনি। ব্যাংকিং সেক্টরের সংকট দেশের অর্থনীতিকে খুব বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে। গত ১০ মাসে দেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো পথে বসে গেছেন। নানান ভয়ভীতি, দোসর তকমা ও মব ফ্যাসিজমের কারণে প্রায় সব ব্যবসায়ী হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। সরকার ভুল পলিসিতে বিদেশিদের ডাকছে; কিন্তু দেশি ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীদের কাছে ডাকছে না। তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করছে না। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও হাতেগোনা কয়েকটি রপ্তানিমুখী খাত ছাড়া বৈদেশিক আয় নেই বললেই চলে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হওয়ার মধ্যেই শুরু হয়েছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। পোশাকশিল্পের নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সেই নতুন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলেছেন, পোশাকশিল্পের চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হয়। ইসরায়েল আর ইরানের যুদ্ধটা আমাদের জন্য একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধের ফলে তেলের দাম বাড়লে তা সবার ওপর প্রভাব ফেলবে। পোশাকশিল্প এর প্রভাব থেকে বাদ যাবে না। পোশাকশিল্প প্রতিনিয়ত নানান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ ব্যাংক সুদ, মুদ্রাস্ফীতি, মজুরি বৃদ্ধি ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির চাপে সবাই নিষ্পেষিত অবস্থায়।
দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য রাজনীতি এবং অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতির অন্ধকার কাটতে শুরু করছে। এখন দরকার অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এ দেশটাকে স্বাবলম্বী করার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য বাড়াতে হবে শিল্পায়ন। তৈরি করতে হবে দক্ষ জনশক্তি। শহীদ জিয়ার পলিসি গ্রহণ করে বেকারের হাত কর্মীর হাতে পরিণত করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের পর দেশে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মানুষ বেকার হয়েছে। এখন দরকার বন্ধ কারখানাগুলো চালুর ব্যবস্থা করা। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বিদেশের শ্রমবাজার ধরার জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। অদক্ষ জনশক্তি, যাদের আমরা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে পাঠাই তারা ২-৩ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ যান; কিন্তু সে টাকাও তুলতে পারেন না। ফলে বিদেশে গিয়ে তার দরিদ্র অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। বরং দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। দেশের মধ্যে রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত বাড়ছে। সবকিছুর জন্য মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য গ্রাম পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত বেকার তৈরি না করে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করতে হবে। নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং বেকারত্ব দূর না করা পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির পালে বাতাস লাগবে না। আর এ কাজটি করার জন্য দেশি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি কাজে লাগাতে হবে। তাদের ভয়ভীতি দূর করে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ অবকাঠামো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকিং সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মব ফ্যাসিজম বন্ধ ও সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীদের আস্থায় রাখতে না পারলে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে না।
সুস্থ রাজনীতি, ভয়ভীতিহীন অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকার দেশবাসীর কাছে চিরদিন সম্মানের আসনে থাকবে। এ তিনটি কাজই বর্তমান সরকারের পক্ষে করা সম্ভব। এর জন্য দরকার সদিচ্ছা। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি যেহেতু জাতি পেয়েছে, বাকি সবকিছুই পাওয়া সম্ভব। দরকার শুধু সদিচ্ছা। সেই সঙ্গে ড. ইউনূসের উচিত হবে চারপাশের চাটুকারের দেয়াল ভেঙে বাস্তবতা উপলব্ধি করা। আবেগ নয়, বিবেকের বিশ্লেষণে আগামীর দিনগুলোকে মূল্যায়ন করা।
♦ লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন