‘আমি প্রায় সাড়ে তিন শ ছবিতে অভিনয় করেছি, আমার তো অর্থের অভাব হওয়ার কথা নয়; কিন্তু এসব ছবির মধ্যে ঠিকমতো দেড় শ ছবির পারিশ্রমিকও পাইনি, নির্মাতারা দেব, দিচ্ছি বলে শুধু ঘুরিয়েছেন অথচ ছবিগুলো হিট হয়েছে, নির্মাতা লাভবান হয়েছেন, কিন্তু এরপরও প্রাপ্য পারিশ্রমিক না পেয়ে আজ দুস্থ অবস্থায় আমার মতো অনেকেরই দিন কাটছে।’ মৃত্যুর আগে এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করে গেছেন ষাট থেকে আশি দশকের দাপুটে অভিনেত্রী রানী সরকার। এ অভিনেত্রী ১৯৫৮ সালে এ জে কারদারের ‘দূর হ্যায় সুখ কি গাঁও’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। খলচরিত্রে তার অভিনয় বেশ জনপ্রিয় হয়। তাই তখনকার প্রায় প্রতিটি ছবিতে রানী সরকার ছিলেন অপরিহার্য। বড় মাপের নামিদামি নির্মাতার ছবিতে একাধারে কাজ করে গেছেন তিনি। একসময় বিয়ে করলেও বেশি দিন টেকেনি তার সংসার। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে এ কিংবদন্তি অভিনেত্রী বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে চলচ্চিত্রে আর অভিনয়ের ডাক পেতেন না। শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব অবস্থায় তার ঠাঁই হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক বস্তির ঝুপড়ি ঘরে। মৃত ভাইয়ের দুই স্কুলপড়ুয়া কন্যা নিয়ে অনাহার আর চিকিৎসার অভাবে কাটছিল তাঁর মানবেতর জীবন। ঘর ভাড়াও দিতে পারতেন না। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগে একাধারে তাঁর অসহায়ত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তৎকালীন সরকার তাকে আর্থিক সহায়তা দেয়। কিন্তু এ অভিনেত্রী যেসব নির্মাতার কাছ থেকে টাকা পেতেন তারা কেউ তাঁর পাশে কিংবা তার মৃত্যুর পরেও দাফন-কাফনের খরচ নিয়ে এগিয়ে আসেননি। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন তাঁকে আর্থিক সহায়তা দিলেও ঘর ভাড়া, চিকিৎসার খরচ, ভাইয়ের মেয়েদের পড়াশোনা ও খাওয়াদাওয়াসহ নিত্য খরচে তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। অভাবের সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের ৭ জুলাই নিঃস্ব-রিক্ত রানী সরকার পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে চলে যান। রানী সরকারের মতো এমন অসহায়ত্বের গল্প ভূরি ভূরি শিল্পীর রয়েছে। অভিনেতা সাত্তার, আকতার হোসেন, বাবর, আনিস, খলিল, মিজু আহমেদ, অভিনেত্রী মায়া হাজারিকা, বনশ্রীসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে এ তালিকায়। যাদের মধ্যে অনেকে আর এ দুনিয়ায় নেই। পারিশ্রমিক না পাওয়ার বিষয়টি আবার উঠে এসেছে নন্দিত অভিনেত্রী ডলি জহুরের আক্ষেপে। ঢালিউড প্রযোজকদের কাছে পারিশ্রমিক বাবদ ৩৪ লাখ টাকা পাওনা তাঁর। এমন অভিযোগ করেছেন সম্প্রতি তিনি। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তাঁর স্বামীর ক্যানসারের চিকিৎসার সময়ও তিনি পরিচালক-প্রযোজকের কাছে পাওনা টাকা চেয়ে পাননি। এখনো পাওনা ৩৪ লাখ টাকার মধ্যে ৩৪ টাকাও কেউ দিচ্ছে না তাঁকে। অথচ বয়স আর অসুস্থতার কারণে অভিনয় কমে গেছে তাঁর। এ ছাড়া শোবিজ অঙ্গনে আগের মতো তেমন আর কাজ হয় না বলে অনেক শিল্পীই এখন বেকার। ‘কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট হয় অথচ সামান্য পারিশ্রমিক দিতে ভুলে যান নির্মাতারা। আমি শুধু আমার কথাই বলছি না, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অহরহ ঘটনা ঘটছে।’ সম্প্রতি এমন অভিযোগ আনেন ‘বরবাদ’ ছবিতে অভিনয় করা অভিনেত্রী দিলরুবা দোয়েল। শাকিব খানকে নিয়ে ‘বরবাদ’ নির্মাণ করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছিলেন মেহেদী হাসান হৃদয়, তাঁর প্রতি শিল্পী-কলাকুশলীদের পারিশ্রমিক না দেওয়ার অভিযোগের কমতি নেই। এর আগে ছবির ভারতীয় চিত্রগ্রাহক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হৃদয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের ডালি তুলে ধরেন। পরে অবশ্য সমঝোতার মাধ্যমে সেটি নিরসন হয়। এভাবে শিল্পীদের ন্যায্য পারিশ্রমিক বঞ্চিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে দিলরুবা দোয়েল বলেন, ‘আমাদের দেশে এনওসি দেওরা পদ্ধতি চালু নেই। যে কাউকে দুই টাকার আর্টিস্ট বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সেই দুই টাকা পারিশ্রমিকের রশিদ দেওয়া হয় না। কেন রশিদ দেন না, কারণ তারা এভাবেই কাজ করবেন। তবে আমার মনে হয় এটা নিয়ে বসা দরকার। দুই টাকা পারিশ্রমিক হলেও তার রশিদ দরকার। তাহলে স্বচ্ছতা থাকবে। স্বচ্ছতা থাকলে নেপথ্যের শিল্পীদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটবে না।’ এ প্রসঙ্গে অভিনেতা আবুল হায়াত জানান, সিনেমায় নিয়মিত অভিনয় করার সময়ে অনেক কাজের পারিশ্রমিক বকেয়া পড়েছিল। সেগুলো অনেকবার চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে পারিশ্রমিক না পেয়ে আর চাননি। সেগুলো নিয়ে আর কথাও বলতে চান না এ অভিনেতা। তিনি মনে করেন, সম্মানির সঙ্গে তো সম্মান জড়িত। সেখানে কেউ পারিশ্রমিকের সম্মানি না দেওয়ার অর্থ হলো- অসম্মান করা। শিল্পী হিসেবে এটা মানতে না পেরে পরে অনেকের কাছে সম্মানি চাননি তিনি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ জানালেন তিনি নিজেও অনেক সময়ই বঞ্চিত হয়েছেন। এ নিয়ে কষ্ট থাকলেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ নেই।
কাজী হায়াৎ বলেন, ‘দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অভিনেতা হিসেবে আমার পারিশ্রমিক তেমন কারও কাছে বকেয়া নেই। যা আছে বলতে চাই না। তবে পরিচালক হিসেবে আমি অনেক ঠকেছি। এগুলো এখন আর বলতে চাই না। আমার ভাগ্যে যেটা ছিল সেটাই হয়েছে।’ প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা দিলদারের মেয়ে মাসুমা আক্তার জানান, ঢালিউড প্রযোজকদের কাছে তাঁর বাবার পাওনা ছিল ৮০ লাখ টাকার বেশি। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ-ই পারিশ্রমিকের অর্থ পরিশোধ করেনি। অভিনেতা জ্যাকি আলমগীরের চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার তিন দশকের বেশি সময়ের। একসময় নিয়মিত কাজ করতে গিয়ে অনেকের কাছে পারিশ্রমিক বকেয়া পড়ে। তিনি বলেন, ‘অনেক আগের বেশ কিছু কাজের পারিশ্রমিক বকেয়া রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাই না।’ শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, টিভি নাটকের পারিশ্রমিকও অনেকের লাখ লাখ টাকা বকেয়া। এ বিষয়ে নন্দিত চিত্র প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অভিযোগগুলো মোটেও ভিত্তিহীন নয়। এ ব্যাপারটি তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, বকেয়ার ব্যাপারটা দুই রকম হয়- প্রথমত, পরিচালকরা প্রযোজকের কাছ থেকে কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করেন। তখন তারা কখনো কাউকে টাকা দেন আবার কখনো দেন না। দ্বিতীয়ত, অনেক প্রযোজক আছেন যারা সরাসরি নির্মাণে যুক্ত থাকেন। দেখা যায় তারা বকেয়া রেখে কাজ করিয়ে ছবি হিট হলেও শিল্পীদের বকেয়া পারিশ্রমিক দেন না। এটি তাদের মন্দ মানসিকতার পরিচয়। তাই আমি বলব, শিল্পীদের কাজ করতে গেলে প্রযোজক এবং পরিচালকদের মানসিকতা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে বুঝেশুনে কাজ করতে হবে। শিল্পীদের যেসব প্রযোজক পরিচালক ঠকায় তাদের কারণে শুধু শিল্পীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পেরও বদনাম হচ্ছে। তাই এ মানসিকতা পরিহার করা জরুরি।