‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য নিয়ে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে পৌঁছে গেছে ওয়ালটন। লক্ষ্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল ইলেকট্রনিকস ব্র্র্যান্ডের তালিকায় স্থান করে নেওয়া। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, আমদানিকারকদের চেয়ে যাতে স্থানীয় শিল্প বেশি সুবিধা পায় সেটি নিশ্চিত করা দরকার।
আপনাদের কম্পানি কী কী পণ্য রপ্তানি করছে, কত দেশে যাচ্ছে?
গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন কারখানায় সর্বাধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে তৈরি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, বেভারেজ কুলার, এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, কম্প্রেসর, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক্যাল, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সেস এবং প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও ইউরোপের অর্ধশতাধিক দেশের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে ওয়ালটন পণ্য। ওয়ালটনের তৈরি কম্প্রেসর রপ্তানির বড় একটি বাজার হচ্ছে ইউরেশিয়া খ্যাত দেশ তুরস্ক। এ ছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতে ওয়ালটনের তৈরি টেলিভিশন ব্যাপক রপ্তানি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান ওয়ালটন পণ্যের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য।
বিদেশে পণ্যের বাজার তৈরিতে আপনারা কিভাবে কাজ করছেন?
গত দশকের মাঝামাঝি থেকে ওইএমের (অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার) আওতায় এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে ওয়ালটন। টেকসই পণ্য, উচ্চ গুণগত মান, এআই, আইওটিসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইনের কারণে ওই সব দেশের বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ওয়ালটনের পণ্য অন্যান্য ব্র্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা জয় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি দশকের শুরু থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল ইলেকট্রনিকস ব্র্র্যান্ডের তালিকায় স্থান করে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, ওশেনিয়াসহ উন্নত বিশ্বের বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড বিজনেস সম্প্রসারণে কাজ করছে ওয়ালটন। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ফিচারের উদ্ভাবনী পণ্যের পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড, আবহাওয়া, ক্রেতাদের চাহিদা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া এসিসি, জানুসি ইলেকট্রোমেকানিকা ও ভার্ডিকটার- অর্ধশতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী এই তিন ইউরোপীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের কম্প্রেসর, এসি-ফ্রিজসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিকস পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করতে যাচ্ছে ওয়ালটন। ওয়ালটনের ব্র্যান্ড বিজনেস সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় মেলায়ও অংশ নিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছে ওয়ালটন।
পণ্যের গুণগত মান ও উদ্ভাবনে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়ালটন?
একটি প্রযুক্তিপণ্যে ক্রেতার আস্থা তৈরি হয় তার গুণগত মানের ওপর। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ স্থাপন থেকে শুরু করে উন্নতমানের বেসিক কাঁচামাল বা কম্পোনেন্টস ব্যবহার এবং কঠোরভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের মাধ্যমে পণ্যের উচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করছে ওয়ালটন। ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি পণ্যে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) বেইসড ব্যাপক বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ইনভার্টার প্রযুক্তিসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-সমৃদ্ধ বিশ্বের সর্বাধুনিক ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও ফিচারের ব্যবহার করছে ওয়ালটন। আমাদের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে।
রপ্তানি আরো বাড়াতে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
দেশি শিল্পোদ্যোক্তারা সরকারের নীতি সহায়তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশে ইলেকট্রনিকস শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটিয়েছেন। ওয়ালটনসহ যেসব কম্পানি এগিয়ে এসেছে, তাদের প্রচেষ্টায় এই খাত এখন ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। একসময়ের সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজার এখন স্থানীয় উৎপাদননির্ভরতায় চলে এসেছে। এই খাতের আমদানিনির্ভরতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বছরে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। এই খাতে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিশিল্পের দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারে ওয়ালটন তথা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত প্রযুক্তিপণ্য ব্যাপক সুনাম অর্জন করছে। প্রযুক্তিপণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে এই খাতের অসাধারণ সাফল্য বজায় রাখতে শিল্পবান্ধব পলিসি সাপোর্ট অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে পলিসিগত কিছু পরিবর্তনও দরকার। যেমন-পরিবেশবান্ধব ও এনার্জি ইফিশিয়েন্ট পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রণোদনা দরকার।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে?
পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং সেখানে ইলেকট্রনিকস খাতের সব পণ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমাদের সুবিধা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে ইলেকট্রনিকসের মাত্র একটি বা দুটি পণ্যের নাম উল্লেখ থাকে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানির তালিকায় ইলেকট্রনিকস খাতের সব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আরেকটু দৃষ্টি দিলে রপ্তানির নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হবে এবং রপ্তানির পরিমাণ আরো দ্রুত বাড়বে। ওয়ালটনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে ভিআরএফ ও চিলার কমার্শিয়াল এসি উৎপাদনকারী নবম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের বাজারে ওয়ালটন এখন কমার্শিয়াল এসি (চিলার) রপ্তানিও করছে। কিন্তু বিদ্যমান পলিসিতে কমার্শিয়াল ভিআরএফ এসির বেসিক কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হচ্ছে, যার ফলে উচ্চ প্রযুক্তির ভিআরএফ এসি দেশে উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে। এই দিকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমদানিকারকদের চেয়ে যেন স্থানীয় শিল্প বেশি সুবিধা পায় সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ালটন কিভাবে কাজ করছে?
জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন নিয়ে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক বাজারে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইউএনডিপির সমন্বয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ওয়ালটন। বিশ্বে ওয়ালটনই প্রথম পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ইউএনডিপির সমন্বয়ে ফ্রিজ ও এসির কম্প্রেসরে ক্ষতিকারক সিএফসি ও এইচসিএফসি গ্যাস ফেজ আউট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ওয়ালটন ফ্রিজ ও এসির কম্প্রেসরে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্বস্বীকৃত পরিবেশবান্ধব আর৬০০এ এবং আর-৩২ ও আর-২৯০ রেফ্রিজারেন্ট। এ ছাড়া পণ্য উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করছে ওয়ালটন। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনে ওয়ালটন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি আমরা। এ ছাড়া টেকসই ক্লিন এনার্জি উদ্যোগের জন্য ওয়ালটন অর্জন করেছে ‘এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’, বর্ষসেরা সবচেয়ে টেকসই ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ‘অনারেবল মেনশন’ ব্র্যান্ড, টানা দুইবার গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড এবং জাতীয় পরিবেশ পদকেও ভূষিত হয়েছে ওয়ালটন।
সৌজন্যে - কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ