অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছে, সেখানে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের চেয়ে পূর্ববর্তী কৌশলের ধারাবাহিকতাই বজায় রাখা হয়েছে। তবে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং সময়ে কিছু সাহসী অর্থায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী চাপ থেকে মুক্ত হলেও, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকায় বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব হয়নি। বাজেটে রাজস্ব সংকোচন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার ভারসাম্য রক্ষা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকার ৫.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং ৬.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় উচ্চতর। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন অনেকটাই নির্ভর করবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর।
বাজেটের আকার এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি, যা অর্জনে দেশি-বিদেশি সম্পদ আহরণ এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।
ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কর ব্যবস্থায় কিছু কাঠামোগত সংস্কার আনা হয়েছে। করপোরেট ট্যাক্স রেট কমানো হয়েছে, আয়করের ক্ষেত্রে করমুক্ত সীমা কিছুটা বাড়ানো হলেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর করের চাপ বেড়েছে।
অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার ‘প্রশ্ন না করার’ সুবিধা বাতিল করাও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ভ্যাট ও শুল্ক কাঠামোয় কিছু রদবদল আনা হলেও বাস্তবায়ন ও কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়ে গেছে।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশই অননুমোদনযোগ্য, যেখানে সুদ পরিশোধ, বেতন ও ভাতা অন্যতম প্রধান খাত। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা কমানো হয়েছে এবং ভাতা বৃদ্ধি নগণ্য, যা বাস্তব মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটে অপর্যাপ্ত। ‘সোশ্যাল রেজিস্ট্রি’ চালুর পরিকল্পনা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হলেও এর কার্যকারিতা সময়সাপেক্ষ।
উন্নয়ন বাজেটেও বড় কোনো নতুন প্রকল্পের ঘোষণা নেই। বিদ্যমান মেগা প্রকল্পগুলো যেমন মাতারবাড়ী বন্দর, মেট্রো রেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পই মূল ফোকাসে রয়েছে। প্রকল্পের সংখ্যা অনেক হলেও বাস্তবায়ন দক্ষতার ঘাটতি এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতা উন্নয়ন বাজেটের ফলপ্রসূতা কমিয়ে দিতে পারে।
সার্বিকভাবে বাজেটটি একটি সীমিত সংস্কারের দৃষ্টান্ত যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও কাঠামোগত রূপান্তরে বলিষ্ঠতা অনুপস্থিত। কর প্রশাসনের স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর পুনর্গঠন এবং উন্নয়ন বাজেটের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। বাজেটের কিছু সাহসী পদক্ষেপ স্বাগতযোগ্য হলেও, বাস্তবায়নের দুর্বলতা ও সংস্কারে সংকোচন এই বাজেটকে মূলত একটি ধারাবাহিক নীতির পুনরাবৃত্তি করে তুলেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির আনুপাতিক হারে সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই ঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা বেড়েছে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা কিছুটা উদ্বেগের।
ঘাটতির মধ্যে এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে। সরকার আশা করছে, উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তা ও চলমান প্রকল্পগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত অর্থের নির্ভরযোগ্য প্রবাহ এ লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আগাম চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বৈদেশিক তহবিল ছাড়ের গতি ও শর্তাবলি বাজেট বাস্তবায়নের গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে, যার বড় অংশ আসবে ব্যাংক খাত থেকে। তবে এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে চাপ পড়তে পারে, বিশেষ করে যদি আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ে। সরকার যদি উচ্চ হারে ব্যাংক ঋণ নেয়, তবে তা সুদের হারে প্রভাব ফেলতে পারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।
আগের বছরের মতো ‘প্রশ্ন না করার’ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সীমিত হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর ও আমদানি শুল্ক কাঠামোতেও আনা হয়েছে কিছু পরিবর্তন। কৃষি ও উৎপাদন খাতের কিছু ভ্যাট ছাড় প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ওষুধশিল্পসহ কিছু কাঁচামালের শুল্ক কমানো হয়েছে। কাস্টমস মূল্যায়নে কর্মকর্তাদের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা প্রশংসনীয় হলেও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।
লেখক : বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ