বগুড়া সদরের নিশিন্দারা এলাকায় ২০ শয্যা বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল নিজেই সর্দি কাশিতে আক্রান্ত। জনবল সংকট আর নিরাপত্তাহীনতায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালটি। যার আশপাশে রয়েছে শুধুই জঙ্গল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি কোনো পুরাতন ভূতের বাড়ি। যেখানে প্রতিনিয়ত ঘোরাফেরা করছে শেয়াল কিংবা অন্যান্য প্রাণী। এছাড়া মূল ফটকে নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় বহিরাগতদের মাদক গ্রহণের আখড়া হিসেবে পরিণত হয়েছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। বহিরাগতরা দিনের বেশিরভাগ সময় এবং সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদকসেবন করে এখানে। যা হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করছে। হাসপাতালের দায়িত্বরতরা কিছুতেই থামাতে পারছেন না মাদকসেবীদের। নিষেধ করলেই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। ফলে জনবল সংকট আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ নার্সরা। নারী চিকিৎসক ও নার্সরাও থাকেন আতঙ্কে।
এদিকে, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অবস্থান দুই মেরুতে। একটি শহরের দক্ষিণে ঠনঠনিয়ায় আরেকটি উত্তরে উপশহরে। ব্যবধান প্রায় ৫ কিলোমিটার। ক্লিনিকটি বহির্বিভাগ (আউটডোর)। আর হাসপাতাল অন্তর্বিভাগ (ইনডোর)। নিয়মানুযায়ী সকল হাসপাতালেই ইনডোর ও আউটডোর একসঙ্গে থাকার কথা। বগুড়ায় এমন ব্যবধানে ইনডোর ও আউটডোর কার্যক্রম চলছে দীর্ঘদিন ধরে। একই সেবার প্রতিষ্ঠান অনেক দূরত্বে দুই জায়গায় হওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতাল ও ক্লিনিক একইসঙ্গে রাখার জন্য স্বাস্থ্যবিভাগে চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
জানা যায়, বগুড়ায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জন্য ১৯৬০ সালে শহরের উপশহর নিশিন্দারা এলাকায় ৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। স্থাপনা নির্মাণ করা হয় ১৯৬১ সালে। ৫ একর এই জায়গায় ছোট একটি একতলা বিশিষ্ট ভবন এবং ২০টি বেড দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে হাসপাতালটি। বাকি জায়গা জঙ্গল ও পশু-প্রাণির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে এটি পুরাতন ভূতের বাড়ি মনে হবে। শুধু তাই নয়, বহিরাগতদের মাদকসেবনের আখড়া হিসেবে পরিণত হয়েছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। এখানে প্রতিদিন বখাটে লোকজন জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে মাদকসেবন করে। এতে করে একদিকে যেমন হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মাদসেবীদের হাতপাতাল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেলও কিছুতেই মানছে না। উল্টো হুমকি-ধমকি দিয়ে যায়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, হাতপাতালের নিরাপত্তার জন্য মেইন ফটকে এজকন নিরাপত্তাকর্মী জরুরি। মাদকসেবীদের ভয়ে আতঙ্কে থাকেন সেবা প্রদানকারীরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালে শুধু যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হচ্ছে। যেখানে প্রতিনিয়ত ১২ থেকে ১৫ জন রোগী ভর্তি হয়। হাসপাতাল নির্মাণের ৬৪ বছর পার হলেও সেখানে চিকিৎসক সংখ্যা এখনো বাড়েনি। হাসপাতালে ২১টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে দু’জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও পদায়নকৃত কোনো চিকিৎসক নেই। ডা. আশরেফা আক্তার নামে একজন মেডিকেল অফিসার সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনিও ডিপুটেশনে। তার কর্মস্থল কাহালু সদর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এছাড়া তিনজন ওয়ার্ড বয়ের মধ্যে ২টি পদে কোনো লোক নেই। একজন রয়েছে। বাবুর্চি পদে কোনো লোক নেই। হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মীও নেই। ফলে জনবল সংকট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেবা কার্যক্রম চলছে বগুড়ার বক্ষব্যাধি হাসপাতালটিতে।
এছাড়া বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আউটডোর (ক্লিনিক) ও ইনডোর (হাসপাতাল) অন্তত ৫ কিলোমিটার দূরে। শহরের ঠনঠনিয়ায় রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগী ভর্তি করার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এই পত্র দিয়ে রোগীকে যেতে হয় ৫ কিলোমিটার দূরে উপশহরের ২০ শয্যার হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ও রিপোর্ট দেখাতে ফের ছুটতে হয় ঠনঠনিয়ায়। রোগী সেরে যাওয়ার পর ছাড়পত্র নিতে হয় ক্লিনিক থেকে। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হন।
এই হাসপাতালে এমডিআর ভবন প্রায় ১৩ বছর আগে নির্মাণ করা হলেও তা হস্তান্তর করা হয়নি। যা এখনো অব্যবহৃত ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে ভবনটির চারপাশে জঙ্গল আর আগাছায় ভরে গেছে। অথচ বিভাগটি সচল থাকলে রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে পারতেন।
বগুড়ার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. আশরেফা আক্তার জানান, সবসময় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে আমারা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বেশির ভাগ সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বহিরাগতরা বিভিন্ন ধরনের মাদকসেবন করে। এতে করে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি। বিশেষ করে রাতে যখন নারী নার্সরা সেবা দেন তখন তারা থাকেন আতঙ্কে। রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজন খাবার নিতে বাইরে গেলে নার্সরা থাকেন নিরাপত্তাহীনতায়।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, হাতপাতালে একদিকে জনবল সংকট অন্যদিকে নিরাপত্তা নেই। দিন-রাত বহিরাগতরা জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে মাদক সেবন করে। আমরা কিছু বলত পারি না। কিছু বললেই হুমকি-ধমকি দেয়। হাসপাতালে সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। তারা ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। ২১টি পদের মধ্যে মাত্র ১১ জন থাকলেও বাকি ১০টি পদ শূন্য। এই হাসপাতালের মেইন ফটকে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো জানানো হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই