দীর্ঘ প্রায় ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদে মোট ৭৪০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পদে ৫৫৫ জন ছাত্র ও ১৮৫ জন ছাত্রী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে নির্বাচনে ১১ হাজার ৯১৯ জন ভোটারের মধ্যে অর্ধেক ছাত্রী ভোটার হলেও নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশেরও কম।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫ পদের বিপরীতে ২৭৩টি এবং আবাসিক ২১টি হল সংসদের ১৫টি করে পদের বিপরীতে মোট ৪৬৭টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এতে কেন্দ্রীয় সংসদে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে কোনো ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। সাধারণ সম্পাদক পদে (জিএস) মাত্র ২ জন ছাত্রী মনোনয়নপত্র তুললেও এর মধ্যে একজন এজিএস পদে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। অন্যজন কোনো দলীয় প্যানেল থেকে মনোনয়ন না পেলে প্রত্যাহার করবেন বলে জানিয়েছেন।
জাকসুতে অংশ নেওয়া মোট ৬২ জন ছাত্রীর মধ্যে ৪৮ জন সংরক্ষিত পদে নির্বাচন করবেন। তবে কোনো কোনো ছাত্রী একাধিক পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সে হিসাবে জাকসুতে অংশ নেওয়া ছাত্রীর সংখ্যা আরও কম। জাকসুর মতো হল সংসদ নির্বাচনেও ছাত্রীদের মনোনয়নপত্র জমাদানের সংখ্যা কম। ১০টি ছাত্রী হলের মধ্যে ৫টিতে নির্ধারিত ১৫ পদই পূরণ হয়নি। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল, সুফিয়া কামাল হল, বেগম খালেদা জিয়া হলে অধিকাংশ পদ শূন্য রয়েছে। মেয়েদের অন্যান্য হলগুলোতে নির্দিষ্ট পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন নেই বললেই চলে। এসব হলে বেশির ভাগ পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে বিজয়ী হতে চলেছেন।
জাকসু নির্বাচনে প্রার্থী কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে নারীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ, ফেক ও ‘বট’ আইডির মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী ও সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট। তাছাড়া, ছাত্রীদের পোশাক ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কতিপয় পেজ সমালোচনা করেছে বলে অভিযোগ তাদের। তবে অনেকে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন। এসব কারণে অনেক ছাত্রী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রার্থী হননি।
জাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক সোহাগী সামিয়া বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সামাজিকভাবে হেয় করার কারণে জাকসু নির্বাচনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কম। নারীদের মাইনাস করার যে রাজনীতি সেটাও দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদের মধ্যে জাকসু নির্বাচনের আমেজ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি বলে মনে করছেন শিক্ষকদের অনেকে।
এ প্রসঙ্গে জাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন পর জাকসু নির্বাচন হচ্ছে, হয়তো সে জন্য ছাত্রীদের সাড়াটা কম। এটার ধারাবাহিকতা থাকলে পরেরবার এ সংকট দূর হবে বলে আশা করি।
অংশ নেবে ৬টি প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা
এবারের জাকসু নির্বাচনে সম্ভাব্য ছয়টি প্যানেলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভোটযুদ্ধে অংশ নেবেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’, ছাত্রশিবিরের ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি প্যানেল, বামপন্থী শিক্ষার্থীদের দুটি প্যানেল। এছাড়া, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত একটি প্যানেল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এখনো তাদের প্যানেলের নাম ও প্রার্থীদের চূড়ান্ত করতে পারেনি বলে জানা গেছে। তাছাড়া, এ নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, আমাদের প্যানেল মোটামুটি চূড়ান্ত। আগামীকাল হয়তো প্যানেল ঘোষণা করব।
নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী-বিজিবি মোতায়েন
এদিকে জাকসু নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্য ২০ জন করে মোট ৪০ জন মোতায়েন করা হবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করবেন। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ফটকগুলোতে কমপক্ষে ৫ জন করে পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। তবে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন মীর মশাররফ হোসেন হল ফটক, প্রান্তিক গেট ও বিশমাইল গেইটে ১০ জন করে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, নির্বাচনের প্রতিটি কেন্দ্রে ৫ জন করে আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এর বাইরে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও নির্বাচনী বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম বলেন, জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রশাসন প্রস্তুত।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল
