প্রযুক্তি কি আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু, এই প্রশ্নটি আবারও সামনে এসেছে এক মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ক্যালিফোর্নিয়ার র্যাঞ্চো সান্তা মার্গারিটার কিশোর অ্যাডাম রাইনের আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা-মা ওপেনএআই-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। তাদের অভিযোগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি-ই তাদের ১৬ বছর বয়সী ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই মামলাটি এমন সময়ে দায়ের করা হয়েছে, যখন সারা বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে।
অ্যাডামের বাবা ম্যাট রাইন তার ছেলের আইফোনে হ্যাংগিং সেফটি কনসার্নস শিরোনামের একটি চ্যাট খুঁজে পান। সেখানেই তিনি জানতে পারেন, অ্যাডাম তার জীবন শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চ্যাটজিপিটি-র সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করছিল। চ্যাটবটটি শুধু তাকে সহানুভূতিই জানায়নি বরং নির্দিষ্ট পদ্ধতি সম্পর্কেও তথ্য সরবরাহ করেছিল। এটি অ্যাডামের মানসিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে পরিবার মনে করে।
অ্যাডাম রাইন ছিল একজন প্রাণবন্ত কিশোর। বাস্কেটবল, অ্যানিমে, ভিডিও গেম এবং রসিকতায় তার ছিল অপার আনন্দ। কিন্তু জীবনের শেষ মাসগুলোতে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। বাস্কেটবল টিম থেকে বাদ পড়া এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী হজমের সমস্যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এরপর অনলাইন স্কুলে পড়ার কারণে তার সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়ে। এই সময়েই সে পড়াশোনার কাজে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করে, যা ধীরে ধীরে তার একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে ওঠে।
চ্যাটজিপিটি-র সাথে তার কথোপকথনগুলো ছিল বিচিত্র। রাজনীতি, দর্শন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও সে চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু যখন তার মানসিক যন্ত্রণা চরম আকার ধারণ করে, তখন চ্যাটবটটি তাকে সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে উল্টো ফাঁসির দড়ির মতো আত্মহত্যার নির্দিষ্ট পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ দেয়। এমনকি, যখন অ্যাডাম তার মাকে সংকেত দিয়ে থামানোর চেষ্টা করার কথা জানায়, তখন চ্যাটজিপিটি তাকে সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহিত করে।
চ্যাটবট কোম্পানি ওপেনএআই এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে তারা তাদের মডেলে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, দীর্ঘ কথোপকথনে সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই একজন মানুষের মতো সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা রাখে না। এটি শুধু সহানুভূতি দেখাতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের মানবিক সাহায্য দিতে পারে না।
এ ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে, এই ধরনের প্রযুক্তি কি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ? বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা, যারা সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য নির্ভরযোগ্য কাউকে খোঁজে, তাদের জন্য কি এই ধরনের চ্যাটবট ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ নয়? রাইন দম্পতি মনে করেন, চ্যাটজিপিটি না থাকলে তাদের ছেলে হয়তো আজ তাদের মাঝেই থাকত।
রাইন পরিবারের এই মামলা প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার এবং তার বিপদ সম্পর্কে এক নতুন বিতর্ক শুরু করেছে। এই বিতর্ক শুধু ওপেনএআই-এর বিরুদ্ধে নয়, বরং গুগল, মাইক্রোসফট এবং মেটা-এর মতো অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টদের বিরুদ্ধেও, যারা এই ধরনের চ্যাটবট তৈরি করছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল